‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] কামাল চৌধুরী

‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] কামাল চৌধুরী

বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা সংগ্রাম আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সুদীর্ঘ পথযাত্রায় এই তিনটি শব্দ আজ অবিভাজ্য। একটিকে অপরটি থেকে বিযুক্ত করা যায় না। তাহলে বাঙালির ইতিহাস খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ থেকে যায় । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির সাহস ও শক্তির উৎস, বাঙালির মুক্তিদাতা।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

তাঁর বজ্রকণ্ঠ ও তর্জনীর বরাভয়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ শত নদীবিধৌত এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মানুষ জেগে উঠেছিল, তারা হৃদয়ে ধারণ করেছিল বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঊর্মিমালা, যার সশব্দ তরঙ্গাভিঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে হানাদার পাকিস্তানি সেনাদল । আমরা বাংলার আকাশে উড়িয়েছি রক্তস্নাত বিজয়ের বৈজয়ন্তী।

১৯৭১ সালে বিশ্বখ্যাত ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ আখ্যা দিয়েছিল। ‘রাজনীতির কবি’ এই অভিধার মর্মার্থ ব্যাপক। কোন অর্থে একজন রাজনৈতিক নেতা রাজনীতির কবি হয়ে ওঠেন। বস্তুত এর সঙ্গে রাজনীতির যেমন সম্পর্ক আছে, তেমনি সম্পর্ক আছে জাতিসত্তার বিকাশ, আন্দোলন ও সংগ্রামের।

নেতা যখন জাতির কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন; যখন জাতির স্বপ্ন, আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠেন সমষ্টির কণ্ঠস্বর তখনই নেতা পরিণত হন রাজনীতির কবিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমুদ্রের বিশালত্ব ও হিমালয়সম উচ্চতায় ধারণ করেছিলেন বাঙালির স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ।

জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তিনি হয়ে ওঠেন জাতির মহানায়ক । অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘নিজের বাঙালিসত্তার গভীর অনুরণন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। কখনো স্বভাবের প্রেরণায়, কখনো সযত্ন উৎসাহে তাঁর উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

দেশবাসীকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সত্তার জাগরণ ঘটাতে। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মোহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সকলের প্রতি । কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছি।

১৯৬৯-এ, ১৯৭০-এ, ১৯৭১ এ, কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা, সেকথা লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়’ (আনিসুজ্জামান/বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু), ৭ই মার্চের ভাষণ।

নেতা যখন জাতির কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন; যখন জাতির স্বপ্ন, আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠেন সমষ্টির কণ্ঠস্বর – তখনই নেতা পরিণত হন রাজনীতির কবিতে । ৭ই মার্চের ভাষণ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এক রাজনীতির কবির মহাকাব্যিক উদ্ভাসনের অসাধারণ উদাহরণ। সেদিন জাতি এই মহানায়ককে প্রত্যক্ষ করেছে জাতির প্রতীকমানুষ হিসেবে। কী তেজোদীপ্ত, কী উদ্দীপনাময়! কী তীব্র ও গতিময়! বঙ্গবন্ধু এ ভাষণে আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাস, বাঙালির আত্মত্যাগের ইতিহাস যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি জাতিকে ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতার।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের তুলনা পৃথিবীতে সামান্যই। জাতিকে এভাবে উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। এ ভাষণ নিয়ে বহু বিশ্লেষণ হয়েছে, আরও হবে । আজ বিশ্ববাসীর কাছেও এ ভাষণ একটি ধ্রুপদী ভাষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ ভাষণে কোনো অস্পষ্টতা নেই।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধু তার ৭ই মার্চের ভাষণে জাতিকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে যুদ্ধ ছাড়া বাঙালির মুক্তি নেই। যে যুদ্ধ আসন্ন তা হবে জনযুদ্ধ । জাতি নিরস্ত্র, কিন্তু জাতির শক্তি তার ঐক্যে। জাতীয় মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের বিকল্প নেই ।

৭ই মার্চের ভাষণের দিন রেসকোর্স মাঠে লক্ষ লক্ষ মানুষ। হাতে লাঠি, মাথায় লালপট্টি – চতুর্দিকে গগণবিদারী স্লোগান, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা,’ ‘আমার নেতা, তোমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ । সারা বাংলার মানুষ সেদিন নেতার নির্দেশের অপেক্ষায়।

বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন, যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বললেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে এবং হুকুম দিতে যদি নাও পারেন তাহলে জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু বন্ধ করে দিতে বললেন।

Google News
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো স্পষ্ট। ৭ই মার্চের ভাষণে দ্বিধাহীন চিত্তে তিনি জাতিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন এ ভাষণে মাছে-ভাতে বাঙালির অনমনীয় দৃঢ়তাও ফুটে উঠেছে বলেছেন, ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’।

বস্তুত তাই ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষ অংশে ব্যক্ত করেছিলেন এদেশের মানুষকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়। ভাষণ শেষে তাঁর সেই তেজোদ্দীপ্ত উচ্চারণ : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। কিন্তু তিনি যুদ্ধরত একটি জাতির কাছে সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত ছিলেন শক্তির প্রেরণা হিসেবে। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত মোজাফ্‌ফ্ফর আহমদ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতায় প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ‘Bangladesh: State of the Nation’ শীর্ষক ভাষণ দেন।

ভাষণে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত, যে সময়ে দুই অসম শক্তি ভয়াবহ এক নিষ্ঠুর সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু এবং শুধু বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন সেই প্রতীক যার চারদিকে নিঃসহায় এক উদ্দেশ্যের সমর্থকরা একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল । কিন্তু এটা কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল না ।

ওই অন্ধকার দিনগুলোতে, ওই অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোতে, যে কোটি কোটি জনতা, যারা ভবিষ্যতের জাতিকে সৃষ্টি করবে তাদের মধ্যে লুকানো কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বিধা ছিল না। বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন প্রতীক। এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে তাঁর আগে অন্য আরও প্রতীক ছিল। কিন্তু ১৯৭১-এর প্রতীক এবং তার আগের প্রতীকগুলোর মধ্যে একটা গুণগত পার্থক্য রয়েছে।

শুধু দুটো উদাহরণ নেয়া যাক। গান্ধী এবং জিন্নাহ দু’জনের প্রত্যেকেই কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন । উভয়েরই ছিল কোটি কোটি ভক্ত। এইসব জনতার কেউই গান্ধী বা জিন্নাহকে তাদের নিজেদের একজন বলে ভাবতে পারত না। এটাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিন্নাহ বা গান্ধীর পার্থক্য। বঙ্গবন্ধু জাতি আর তাঁর নিজের মধ্যে একটা অবিভাজ্য মেলবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন’ (আবদুর রাজ্জাক/”বাঙালি জাতি: বঙ্গবন্ধু)’।

এই প্রতীক মানুষের ডাকে বাঙালি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিল। আপামর জনগণ নেমে পড়েছিল যুদ্ধে । তারা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে জাতিসত্তার মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিল । বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রস্তুতির কাছে পরাভূত হয়েছে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী্

[ ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] ]

লেখক: ড. কামাল চৌধুরী
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] কামাল চৌধুরী
‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] কামাল চৌধুরী
আরও পড়তে পারেন :

Leave a Comment