‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবেঙ্গলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই ।’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] অজয় রায়
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণটি জগদ্বিখ্যাত নেতৃবৃন্দের প্রদত্ত ভাষণসমূহের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, যা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে অনন্য অবদান রেখে চলেছে। বিশ্বের সেরা ভাষণের এই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, স্বাধীনতালাভের প্রাক্কালে ভারতের কেয়ারটেকার মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু প্রমুখ।
সেদিক থেকে বিচার করলে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি স্বাধীনতাকামী সাত কোটি বাঙালির ভাগ্য নির্ধারণে একটি নিয়ামক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে ।
বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। এই ভাষণে তিনি শোনান সেই স্বাধীনতার কথা, জানিয়ে দেন জনগণের সার্বিক মুক্তির কথা। কিন্তু তাঁর ভয় ছিল – ঘরে বাইরে শত্রু থাকতে পারে, সংগ্রামকে বানচাল করতে পারে। ভয় ছিল সাম্প্রদায়িকতার সাম্প্রদায়িক শক্তি পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে।
১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা নানাভাবে বানচাল করার চেষ্টা করেছে । সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়া হয়েছে । তাই তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ই মার্চের ভাষণে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে পুন-জাগ্রত করে, সাবধান করেছেন তিনি। কেউ যাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে না পারে, সেজন্যই বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে উচ্চারিত হয় শিরোনামধৃত ওই ভাই সম্বোধন।
‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে।’ এর পরেই তিনি দেশের সব সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মানুষকে আপন ভাই হিসেবে সম্বোধন করে তাদের সকলকে রক্ষার দায়িত্ব জনগণের ওপর অর্পণ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের যেন বদনাম না হয় ।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার । একথা তিনি বারবার প্রমাণ দিয়ে গেছেন । তবে ধর্মপ্রাণ বাঙালি জনগণের ধর্মীয় অনুভূতির পটভূমিতে ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থে পাশ্চাত্যের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে তিনি এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলেছেন যে, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই নিরাপদে যার যার ধর্ম পালন করতে পারবে নির্ভয়ে বাংলাদেশে।
২১-২৩ অক্টোবরে, ১৯৫৫ সালে কাউন্সিলে দলের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি পরিত্যক্ত হয় এবং পার্টির নতুন নাম ‘পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ গৃহীত হয় । এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক এবং সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যার ফলে পার্টির দরজা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায় ।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সারা জীবনের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করেছেন । ছাত্রজীবন থেকেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তা ছিলেন । ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন । সেখানে তিনি ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তেন। ঢাকায় এসে আইনের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন, আর জড়িয়ে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলনে। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে ফজলুল হক মুসিলম হলে আওয়ামী লীগ গঠনের আগেই গঠিত হলো মুসলিম ছাত্রলীগ। পরে ছাত্রলীগ ‘মুসলিম’ শব্দটি পরিত্যাগ করে ১৯৫৬ সালে ।
স্বার্থান্বেষী মুসলিম লীগের কবল থেকে আম জনতাকে মুক্ত করতে গঠন করেন প্রতিবাদী রাজনৈতিক দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ অর্থাৎ জনতার লীগ গঠন করেন ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে, পরবর্তীকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে যুক্ত হন।
এখানে উল্লেখ্য যে, ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম ও গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে পরাস্ত করে নির্বাচনে জয়ী হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এরই পশ্চাৎপটে মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগের তরুণ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের উদ্যোগে পার্টির তিনদিন ব্যাপী কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর, কাউন্সিলে দলের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় – নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি পরিত্যক্ত হয় এবং পার্টির নতুন নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ গৃহীত হয়। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক এবং সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যার ফলে পার্টির দরজা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। এর ফলে জননেতা ফণীভূষণ মজুমদারের মতো মানুষ পার্টির সদস্য হন, সদস্য হন ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজ ।
দল হিসেবে সেক্যুলার চরিত্রকে সাংগঠনিক রূপ প্রদানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ভিত্তি নিখুঁত করা হয়। এই সেক্যুলারাইজেশন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড়ো অবদান এসেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে।
তাই ৭ই মার্চের ভাষণেও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগ্রত করেছেন তিনি। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি সাবধান করেন – কেউ যাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে না পারে, সেজন্যই বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে উচ্চারিত হয় শিরোনামধৃত ওই ভাই সম্বোধন।
[ ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবেঙ্গলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই ।’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] ]
লেখক : অধ্যাপক অজয় রায়
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়তে পারেন :