পাটগ্রাম মুক্তাঞ্চল, মুক্তিযুদ্ধে মুক্তাঞ্চল – আমিনুর রহমান সুলতান : অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই পাটগ্রামের সংগ্রামী জনতা দুর্বার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। কাজী নূরুজ্জামান সূত্রে জানা যায়, মো. আবিদ আলী এমপিএ-র নেতৃত্বে ‘১৪/১৫ মার্চ গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। ১৩৩ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন মো. আবিদ আলী এমপিএ। ‘সংগ্রাম পরিষদের প্রথমে সম্পাদক নির্বাচিত হন-পাটগ্রাম কলেজের শিক্ষক গাইবান্ধার আবু হোসেন চৌধুরী। তিনি তাঁর বাড়িতে চলে যাবার পর সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক নির্বাচিত হন কাজী নূরুজ্জামান। ৩৪ কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন নবাবউদ্দিন পণ্ডিত।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সংগ্রাম পরিষদের নেতা জলিলুর রহমান সূত্রে জানা যায়, এদিনেই পাটগ্রামের বিওপি ক্যাম্পে বাঙালি ইপিআর অবাঙালি ইপিআরদের হত্যা করে এবং সব কয়টি ভিওপি ক্যাম্প বাঙালি ইপিআরদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এরপর থেকে জোরদার করা হয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা। ২৭ মার্চ আন্দোলনরত পাটগ্রামবাসীরা পাটগ্রাম টি এন উচ্চবিদ্যালয়ে এক বিশাল জনসভায় যোগ দেন।
এ জনসভার আহ্বান করা হয় যার নেতৃত্বে তিনি হলেন— মো. আবেদ আলী এমপিএ। বিকাল ৩টার আগেই লাঠি, দা, ছুরি, বল্লম, কুড়াল, বন্দুক প্রভৃতি হাতে মানুষের ঢল নামে উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। জনসভায় তৎকালীন বাঙালি ইপিআর ও থানার কর্মচারীদের অস্ত্রসহ হাজির হবারও আহ্বান জানিয়েছিলেন আবিদ আলী। থানার ওসি কায়েতউল্লাহ ও সুবেদার বোরহান উদ্দিনও উপস্থিত হন জনসভায়। স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগদানের লক্ষ্যে শপথ গ্রহণ করান তিনি।
সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভূমিকা রাখেন জলিলুর রহমান (পাটগ্রামে তিনি জলিলার রহমান নামে পরিচিত), তফিজ উদ্দিন আহমেদ, আজিজার রহমান, আবুল হোসেন, জবেদ মিয়া, শাহ এন্তাজউদ্দিন আহমেদ, তোজাম্মেল হোসেন, আফতাব উদ্দিন, আশরাফ মিয়া, আশকার আলী, এন্তাজউদ্দিন (বাউরা), তবিবুর রহমান বসুনিয়া, দিনার উদ্দিন, দবির উদ্দিন আহমেদ, আহসানুল হক ইদু, মো. আবু আইয়ুব প্রধান, লালচাঁদ রজক, শাহাদাৎ হোসেন (মাস্টার) প্রমুখ।
সংগ্রাম পরিষদের পাশাপাশি ছাত্রনেতৃবৃন্দও অনন্য ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে পাটগ্রাম থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আশরাফুল হক, সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম এবং অন্যান্য ছাত্রনেতৃবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মোশারফ হোসেন মশু, আখতারুল ইসলাম রতনা, দৌলতুজ্জামান, রেজাউল আলম, আবদুল কাদের, আবদুল জব্বার প্রমুখ। ৩৬
পাটগ্রাম থানায় উত্তাল মার্চ থেকেই নারীরাও আন্দোলন সংগ্রামে এগিয়ে আসেন। পাটগ্রামে সংগ্রাম পরিষদের পাশাপাশ মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সভানেত্রী ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন যথাক্রমে মোমেনা আবেদ ও সাজেদা আইয়ুব। এছাড়া সহসভানেত্রী ও সহসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান যথাক্রমে ফাতেমা তাফিজ ও হোসনে আরা বুলি। কোষাধ্যক্ষ হন আনোয়ারা তোজাম্মেল ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নিযুক্ত হন বদরুন নাহার তানি। যুদ্ধকালীন অবস্থায় নারী সমাজকে সংগঠিত করেছিল এই নারী সমাজ। ৩৭
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যাতে পাটগ্রামে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রতিরোধও গড়ে তোলা হয়। এ সম্পর্কে আবিদ আলী যে তথ্য তাঁর লেখায় বর্ণনা করেছেন তা উল্লেখ করা হলো- “এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ হতে অবস্থা চরমের দিকে যেতে থাকল। কেমন করে এলাকার লোককে নিরাপদে রাখা যায় তার চিন্তা মাথায় এলো। এ এলাকার একমাত্র যোগাযোগ রেলপথ দিয়ে যেকোনো সময় হানাদার বাহিনী এসে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিল।
ভাবতে থাকলাম যদি রেললাইন তুলে ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা যায় তাহলে হয়তো পাকবাহিনী এলাকায় ঢুকতে পারবে না এবং এলাকার সবলোক নিরাপদ বসবাস করতে পারবে। জনতাকে আবার ডাক দেই। রেললাইন তুলে ফেলতে প্রথমে অনেকে ইতস্তত করল। তখন আমি নিজে হাতুড়ি ও শাবলের মাধ্যমে রেললাইন তুলে ফেলা উদ্বোধন করি।
এরপর হাজার হাজার ছাত্র জনতা রেললাইন সম্পূর্ণভাবে উপড়ে ফেলতে লাগলো। বুড়িমারী হতে বড়খাতা পর্যন্ত রেললাইন সম্পূর্ণভাবে তুলে ফেলা হয়। ভোটমারী পর্যন্ত রেললাইন তুলে ফেলার প্রবল ইচ্ছা ছিল কিন্তু সম্ভব হয়নি। হানাদার বাহিনী পরে বড়খাতা পর্যন্ত এসে তাদের যুদ্ধের ঘাঁটি সেখানেই গড়ে তুলেছিল।
মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাটগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান অনুকূলে ছিল। এছাড়াও বড়খাতা পর্যন্ত রেললাইন উপড়ে ফেলা এবং বাউরায় মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার ভূমিকা ছিল অন্যতম। ফলে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাটগ্রামে ঢুকতে সাহস পায়নি। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করার পর দেশের অভ্যন্তরে একটি মাত্র সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল পাটগ্রাম মুক্তাঞ্চলেই। পাটগ্রাম থানাধীন বুড়িমারীর হাশর উদ্দিন হাই স্কুলে স্থাপিত হয়েছিল এর হেড কোয়ার্টার। ৬ নম্বর সেক্টরটি আবার ৫টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। সাব-সেক্টর বাউরা ছিল পাটগ্রামের অন্তর্ভুক্ত।
পাটগ্রামকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পর ক্রমে ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য এ অঞ্চলে গড়ে তোলা হয় প্রশিক্ষণ ও রিক্রুটিং ক্যাম্প।
বুড়িমারীর বড়াইবাড়ি ক্যাম্প:
পাটগ্রাম মুক্তাঞ্চলের বুড়িমারীর ধরলা নদীর বিস্তীর্ণ চর অঞ্চল বড়াইমারি নামে পরিচিত ছিল। এখানে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ছাত্র, যুবক ও সাধারণ জনতাকে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ দিয়ে এখান থেকে তাদের রিক্রুটিং করে পাঠানো হতো ভারতের বিভিন্ন যুব শিবিরে।
ক্যাম্পের পাশে ধরলার ওপারেই ভারতের চাংরাবান্ধা। এই ক্যাম্পটির ভৌগোলিক পরিবেশগত বর্ণনা দিয়েছেন তৎকালীন পাটগ্রাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা মো. আশরাফুল হক। এক্ষেত্রে তাঁর বর্ণনাটি তুলে ধরা হলো। ‘চাংরাবান্ধার কাছে ধরলার তীরে সারি সারি বড়ই গাছ। বিস্তৃত মাঠের মাঝখানে একটি শিমুল গাছ। তারই মধ্যে আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হলো।
এই ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মো. আবিদ আলী এমপিএ। তাঁকে সহযোগিতা করেন কাজী নূরুজ্জামান, আজিজার রহমান, নবাবউদ্দিন পণ্ডিত, আবুল মাস্টার, জবেদ মিয়া, শাহ এন্তাজ উদ্দিন আহমেদ, তোজাম্মেল হোসেন, আফতাব উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে যাতে হেলিকপ্টারসহ হালকা বিমান উঠানামা করতে পারে সেজন্য ধরলা নদীর দক্ষিণ দিকের মাঠে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা হয় একটি রানওয়ে।
এই ক্যাম্পে ছাত্র-যুবক ও জনতাকে কয়েকটি প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হতো ভারতের বিভিন্ন যুব শিবিরে।
মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন ও অন্যান্য কার্যক্রম:
পাটগ্রামের মুক্তাঞ্চলের বেসামরিক কার্যক্রম সম্পর্কে আবিদ আলী বলেন, “আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পাটগ্রাম থানায় কায়েতুল্ল্যা ওসির অধীনে প্রায় দুইশত ‘মুক্তি পুলিশ’ ছিল, পাশাপাশি সিভিল প্রশাসনও কার্যকরী ছিল। যুদ্ধকালীন প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন জনাব তফিজ উদ্দিন আহমেদ, সম্মুখ রণক্ষেত্রের সমন্বয়কারী ছিলেন জলিলুর রহমান। বিপ্লবী সাংস্কৃতিক শিল্পী গোষ্ঠীর প্রধান সংগঠক ছিলেন প্রখ্যাত রেডিও শিল্পী মাস্টার সিরাজ উদ্দিন আহমেদ।
সংগ্রাম পরিষদের সদস্য লালচাঁদ রজক এ সম্পর্কে বলেন, “নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হতে আমাকে থানা কমান্ডারের পদ দেওয়া হলো। আর সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হলো হাকিম আহমেদ রউফকে। এভাবে একটি প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা হলো এখানে। সিভিল বন্দুক, ইপিআরদের রাইফেল নিয়ে গড়ে তোলা হলো নিজস্ব ভাণ্ডার। মুক্ত এলাকায় ডাক, স্থলশুল্ক বিভাগ চালু রাখা হয়।
… ৬ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার বুড়িমারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রুষা করার জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। প্রায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি ঐ হাসপাতালের কাজে জড়িত ছিলাম। মুক্ত এলাকাকে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ প্রশাসনিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়। নাম দেওয়া হয় Zonal Administrative office, North Zone. কুচবিহারে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এবং Zonal Administrator ছিলেন দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক জনাব ফয়েজউদ্দিন আহমেদ (বাংলাদেশ হওয়ার পর সংস্থাপন সচিব হয়েছিলেন)।
জোনাল অফিস হতে সে সময় পাটগ্রামের পোস্টমাস্টার জনাব ফায়জুল বারীকে প্রধান করে আমাকে এবং আবু আইয়ুব প্রধানকে কাস্টমস অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমরা তখন পাটগ্রামের নাজির গোমানী এলাকার ককোয়াবাড়িতে বসতাম। সে সময় কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে যাবতীয় বেচাকেনার কাজ ভারতে গিয়ে করতে হতো। এসব বেচাকেনা করতে যারা ভারতে যেতো তাদের কাছে কর আদায় করতাম এবং কর বাবদ যা আদায় করতাম তা জোনাল অফিসে জমা দিতাম। এই টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে ব্যয় করা হতো। আর এ থেকে আমাদের নিয়মিত বেতন দেয়া হতো। ১
অধ্যক্ষ (অব.) প্রফেসর মো. আবু আইয়ুব প্রধানের লেখা থেকেও এর সমর্থন মিলে। তিনি তাঁর এক লেখায় বলেছেন, “ইতোমধ্যে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার হতে আমাদের কলেজের প্রভাষকদের নামে সহকারী কাস্টমস অফিসার হিসেবে নিয়োগপত্র এলো। সংসদ সদস্য মরহুম আবিদ আলীর পরামর্শে আমি, বাবু লালচাঁদ রজক ও জনাব কামরুল হক সরকার উক্ত কাজে যোগদান করলাম। আমাদের দায়িত্ব হলো ভারতীয় সীমান্তের চেক পোস্টে কর আদায় করা এবং কুচবিহার জোনাল অফিসে তা জমা করা। জমাকৃত অর্থ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের কাজে ব্যয় করা হতো।”৪২
মুক্তাঞ্চলে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদ:
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পাবার পরও পাটগ্রাম মুক্তাঞ্চলে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার পেছনে রয়েছে বিশেষ পটভূমি। এ মুক্তাঞ্চলে প্রত্যক্ষভাবে যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের নিয়ে সায়েদুল ইসলাম মিঠু তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ” লেখায় যে শ্রেণি বিন্যাস করেছেন তাতে আমরা দেখতে পাই, অধিকাংশই ছিলেন বিত্তহীন বা নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এছাড়াও বিভিন্ন পেশার লোকদের মধ্যে ছাত্ররাই ছিল বেশি। ৪৩
মুক্তিযোদ্ধাদের সামনা-সামনি বিপ্লবী ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা ও মনোবল চাঙা করার জন্য এমপিএ আবেদ আলীর নেতৃত্বে সংগীত শিল্পী ও সংগীত প্রিয়দের নিয়ে জুলাই মাসের মাঝামাঝি মুক্তাঞ্চলে গঠন করা হয় ‘বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদ’। পরিষদের গঠন কাঠামো ছিল নিম্নরূপ :
সভাপতি: এম. আবিদ আলী (এমপিএ, পাটগ্রাম-হাতীবান্ধা থানা)
সহসভাপতি: তফিজউদ্দীন আহমেদ
সম্পাদক: মোশারফ হোসেন মশু
প্রচার সম্পাদক: এম. আনোয়ারুল ইসলাম নাজু
পরিচালক: মোহাম্মদ সিরাজউদ্দীন (রংপুর বেতারের নিজস্ব শিল্পী)
পরিষদে যুক্ত ছিলেন মো. আবু আইয়ুব প্রধান (সদস্য, ধারা বর্ণনাকারী), আনোয়ারুল ইসলাম (সদস্য, ধারা বর্ণনাকারী), বদরুন্নাহার তানি (সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী), মো. শাহজাহান (সদস্য, তবলা বাদক), মো. শাহজামাল তোতা (সদস্য, সংগঠক ও কণ্ঠশিল্পী), রতন লাল সাহা (সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী), আবু বক্কর সিদ্দিক প্রধান (সদস্য, সংগঠক ও বংশী বাদক), কে. কে. সিদ্দীক (সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী), মোজাম্মেল হক (সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী), শামীমা বেগম বিউটি (সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী), সাজেদা খাতুন মনান (সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী), আলম আরা ইকবাল বানু হেলেন (সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী), খামেরুল ইসলাম প্রধান (সংগঠক) ও আবুল কালাম আজাদ (সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী)।
বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদের প্রাণপুরুষ ছিলেন মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন। তিনি রংপুর বেতারের সংগীত প্রযোজক ছিলেন। তিনি রংপুর বেতারে সুনাম অর্জনকারী কণ্ঠশিল্পী। সংগঠনের রিহার্সাল হতো আবু বক্কর সিদ্দিক প্রধানের বাসায়। কয়েকদিনের মধ্যেই বিপ্লবী গান রেওয়াজের মধ্য দিয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় গীতিনকশা ‘বিপ্লবী বাংলা’-র। গীতিনকশাটি তৈরির ক্ষেত্রে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদের কণ্ঠশিল্পী ও কলাকুশলীদের যৌথ ভূমিকা রয়েছে। বিপ্লবী গান ও গীতিনকশাটি পরিবেশনাকালে ধারা বর্ণনা দিতেন আবু আইয়ুব প্রধান ও এম. আনোয়ারুল ইসলাম নাজু।
সাংস্কৃতিক দলটি শুধু মুক্তাঞ্চলেই নয়, ভারতের বিভিন্ন স্থানেও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান ও গীতিনকশা পরিবেশন করেছে। এ সম্পর্কে আবু বক্কর সিদ্দিক বলেছেন, “কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। এবার যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার পালা। তবে শত্রু নিধন করতে নয়- মিত্রদের উৎসাহ দিতে।
সাধারণত সকাল ৮/৯টার দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে যেতো সোজা বাউরা। সেখানে ক্যাপ্টেন মতিয়ার রহমানের অস্থায়ী ক্যাম্পে। হাল্কা চা নাস্তা খাইয়ে তিনি আমাদের জিপে করে নিয়ে যেতেন মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স ঘাঁটিতে। কখনও খোলা মাঠে অথবা ভাঙা ঘরে আমাদের অনুষ্ঠান করতে হতো। মাঝে মধ্যে আমাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর শিবিরেও যেতে হতো।
বিপ্লবী বাংলা গীতিনকশায় কয়েকটি প্রাণস্পর্শী ও উদ্দীপনামূলক গান ছিল। শিল্পী মোহাম্মদ সিরাজউদ্দীন একটি গানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। গানটি ভাওয়াইয়া সুরে গাওয়া হতো। এক্ষেত্রে গানটির প্রথম অংশ উল্লেখ করা হলো
দেশ হামার স্বাধীন বাংলারে
হামার জন্মস্থান এদেশেতে
মহান নেতা মুজিবুর রহমানরে ॥৪৭
শাহ জামাল তোতা জানান, যেসব বিপ্লবী গান তাঁরা পরিবেশন করতেন সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য গানের প্রথম পংক্তি হচ্ছে –
১. কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট
২. রুখে দাঁড়াও, রুখে দাঁড়াও থাকিতে প্রাণ
৩. পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল
৪. ছোটদের বড়দের সকলের
৫. হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে
৬. তীর হারা ঐ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে প্রভৃতি। ৮
মো. আনোয়ারুল ইসলাম নাজুও পরিষদের গান পরিবেশনা সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছিল তা স্মর্তব্য, “এ পরিষদের মাধ্যমে মুক্তাঞ্চলের বুড়িমারী, বড়খাতা, পাটগ্রামের বিভিন্ন স্থানে দেশাত্মবোধক গান, ধারা বর্ণনার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও যুদ্ধাবস্থার চিত্র তুলে ধরতাম।”৪৯
‘বিপ্লবী বাংলা’ গীতিনকশা সম্পর্কে বদরুন নাহার তানির মন্তব্য উল্লেখযোগ্য : “মুক্তিবাহিনীতে উৎসাহ দেবে, তাদের বীরত্বের প্রশংসা করা, দেশমাতৃকার সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখা, দেশ প্রেমের জয়গান করাই ছিল গীতি নকশার মূল বক্তব্য।” প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে গীতিনকশাটি পাটগ্রাম মুক্তাঞ্চলে পরিবেশিত হয়েছিল।
তাজউদ্দীন আহমদ খুবই প্রশংসা করেছিলেন গীতিনকশাটির। শুধু তাই না, “তাজউদ্দীন আহমদ বিভিন্ন মুক্তিক্যাম্পে গিয়ে গীতিনকশাটি পরিবেশন করতে বলেন। এর পরেই বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদ বিভিন্ন মুক্তিক্যাম্পে গিয়ে অনুষ্ঠান করতে থাকে।… ১৯৭১ এর ২ ডিসেম্বরের ‘রণাঙ্গন’ সংবাদপত্র এই প্রচেষ্টাকে “বীরোচিত পদক্ষেপ” বলে আখ্যায়িত করেছিল। ৫০
মুক্তাঞ্চলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ:
পাটগ্রাম মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক কার্যক্রমসহ নানা ধরনের সামরিক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয়। ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী এ মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে আসেন। মুক্তাঞ্চলে এসে তিনি উদ্বোধন করেন বুড়িমারী সীমান্ত ভিসা ও শুল্ক অফিস। উদ্বোধনের সময় তিনি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। সাইনবোর্ড টাঙানো ছিল আগেই। সাইনবোর্ডের উপরের অংশে লেখা ছিল ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মাঝখানে বাংলাদেশের পতাকা আঁকা, নিচের অংশে দুটি লাইনে লেখা : ‘সীমান্ত ভিসা ও শুল্ক দপ্তর’, বুড়িমারী, বাংলাদেশ’।
পরিদর্শন করেন- পাটগ্রামের সীমান্ত অফিস, পোস্ট অফিস, থানা, বালিকা বিদ্যালয়, আওয়ামী লীগ শাখা অফিস। পাটগ্রাম হাই স্কুলমাঠে রাতে সমবেত হয় বীরজনতা। তাঁর সফর ও সফরের সময় বক্তৃতার অংশ ছাপা হয় যুদ্ধকালীন জয় বাংলা পত্রিকায়। সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সৈনিকবেশে। তাজউদ্দীন আহমদ বীর জনতার উদ্দেশে ভাষণে বলেন, “এ যুদ্ধ আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধ। জয় আমাদের হবেই।
আপনারা মুক্তাঞ্চলের অধিবাসীরা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করুন-মনে রাখবেন বাংলার প্রতিটি মানুষই আজ একজন মুক্তিযোদ্ধা। মাতৃভূমি থেকে শেষ হানাদার শত্রুকে খতম অথবা বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এ যুদ্ধ আমাদের চালাতে হবে।… বাংলার মানুষের নয়নমণি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে আমরা আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনবই।” ভাষণ শেষে সারা মাঠ প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, বাংলা’ ধ্বনিতে ৫১ জয়
প্রধানমন্ত্রী রাত্রিযাপন করেন ৬ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টার বুড়িমারী হাশর উদ্দিন হাই স্কুলে। মুক্তাঞ্চলে গঠিত ‘বিপ্লবী সাংস্কৃতিক শিল্পী পরিষদ’ তাজউদ্দীন আহমদের সফরকে অভিনন্দন জানাবার জন্য পাটগ্রাম থানা সদর কার্যালয়ে পরিবেশন করে বিভিন্ন বিপ্লবী গান ও ‘বিপ্লবী বাংলা’ নামে একটি গীতিনকশা। গীতিনকশাসহ অনুষ্ঠানটির ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান উপস্থিত দর্শকবৃন্দ। অনুষ্ঠানটির নেতৃত্ব দেন খ্যাতনামা রেডিও শিল্পী সিরাজউদ্দিন আহমেদ।
মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে আরো এসেছিলেন অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকী, এএইচএম কামারুজ্জামান, ব্যারিস্টার আমীর-উল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোস্তফা সারওয়ার প্রমুখ। তাঁরা সবাই মুক্তাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলেছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন।
মুক্তাঞ্চলে বিদেশি সাংবাদিক বিশিষ্ট ব্যক্তি:
অন্যান্য মুক্তাঞ্চলের মতো পাটগ্রামের মুক্তাঞ্চলেও অনেক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি এসেছেন। মুক্তাঞ্চল ঘুরে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রচার করেছেন। বিশ্বজনমত দ্রুত গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভূমিকা অনন্য। এমপিএ মো. আবিদ আলীর লেখাতে জানা যায়, ব্রিটেনের শ্রমিকদলের খ্যাতনামা এমপি ডোনাল্ড চেজওয়ার্থও এ মুক্তাঞ্চলে এসেছিলেন।
“তাঁর ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে পাটগ্রামের বিভিন্ন অফিস ও রণাঙ্গনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি তুলে নিয়ে সেগুলো পরবর্তীকালে লন্ডনে প্রদর্শন করেছিলেন। শুধু ব্রিটেনেই নয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলিতেও তিনি মুক্ত পাটগ্রাম এলাকার ও বাউরা সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি প্রদর্শন করেছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠায়, দেশের অভ্যন্তরেই স্থানীয় পর্যায়ে বেসামরিক প্রশাসন চালু হওয়ায়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠা-সহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়াও মুক্তাঞ্চলগুলোতে আশ্রিত মানুষদের আশ্রয়ের পাশাপাশি তাঁদের নিরাপত্তাসহ খাবার-দাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ বাঙালি জাতির মানবিক মূল্যবোধকেও প্রতিষ্ঠা করেছে।
আরও পড়ুন: