আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায় বাংলার মানুষ তার অধিকার চায় – বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এর একটি বিশেষভাবে স্মরণীয় বাক্য !!! বক্তব্যের এই অংশটি বিশ্লেষন করেছেন জনাব মুস্তাফা নূরউল ইসলাম।
মহাকাল ধারণ করে আছে এমন কিছু মন্ত্র উচ্চারণ, সেগুলো কখনো নিঃশেষে পুরনো হয়ে যায় না, কখনো ধার হারায় না। তবে বাস্তবতার প্রাত্যহিকতার অনিবার্য চাপে আমরা প্রতিনিয়ত পিষ্ট হই এবং তাৎক্ষণিকতার দাবি মেটাবার তাগিদে আমরা সবসময় ব্যস্ত থাকি । তথাপি শাশ্বত সত্য হলো, মানবপ্রাণের উদ্গাতা সব প্রেরণামন্ত্র শেষ পর্যন্ত কিন্তু মার খায় না এবং সাধারণ মানুষের দিনাতিপাতের কোনো গভীর ফল্গুধারায় সতত বহমান থাকে। তারপর একসময়ে কোনো উপলক্ষের অবলম্বনে উচ্চকণ্ঠ ডাক আসে । আমরা তখন ইতিহাস-সচেতন হই, বর্তমান সম্পর্কে সতর্ক হই এবং সেই ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতের দিশায় প্রত্যয়ী হয়ে উঠি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত উজ্জ্বল ও দিক-নির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত ৭ই মার্চ [ ৭ই মার্চের ভাষণ ] এক উল্লেখযোগ্য বাঁক, যে বাঁক আমাদের দিয়েছে স্বাধীন এ দেশ। লক্ষ করার বিষয়, ৭ই মার্চকে অবলম্বন করে এসেছে মানুষের অধিকার, মুক্তি, স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দাবি ও সাধারণের স্বার্থে তাদের নিজেদের সরকার । বিশ শতকের শেষ প্রহরে বিশ্ব ভূখণ্ডের কোন ক্ষুদ্র প্রান্তবর্তী এক অঞ্চল বাংলাদেশ তার মুক্তির জন্য লড়াই করেছে। একাত্তরের এই দিনে শেখ মুজিব নামে মহান নেতা ডাক দিয়েছিলেন :
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে বলেন ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায় ।… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
আমাদের সবার হয়ে সুস্পষ্ট করে মহান নেতা জানিয়ে দিলেন এই দে ‘বাংলাদেশ’। আমরা অতঃপর ভৌগোলিক অবস্থানে সীমানাবেষ্টি পলিটিক্যাল দেশ-পরিচিতিটা বুঝে নেব। অবশ্য এ নয় সুপ্রাচীনকালে প্রাচ্য ভূমিখণ্ড বিশেষ— ঢালাও উল্লেখে যা পশ্চিমে রাঢ়ভূমি থেকে পুরে সমতট-হরিকেল, উত্তরে পৌণ্ড্রবর্ধন থেকে দক্ষিণে চন্দ্রদ্বীপজুড়ে প্রসারিত মৌর্যযুগের রেকর্ডে এই ধরনের নাম পাওয়া গেছে ‘বঙ্গাল’; মুঘ সাম্রাজ্যাধীনে তখন তা ‘সুবে বঙ্গালহ্’; ইংরাজ রাজত্বের প্রশাসনিক বিভাজন ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’; এবং বিগত শতকে সাতচল্লিশ- আগস্ট কাল থেকে যখন পাকিস্তান ততদিনে নাম-পরিচিতিতে কখনো ইস্টবেঙ্গল/পূর্ববাংলা, কখনো ইস্ট পাকিস্তান/ পূর্ব পাকিস্তান। অতঃপর যখন সাত কোটি মানুষের জন্য ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ – এর ডাক এল, তখন থেকে জেনে গেলাম – আমার জন্মভূমি স্বদেশভূমি নাম ‘বাংলাদেশ’।
দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বারবার এসেছে ‘বাঙালির কথা’ ও তাদের অধিকারের কথা’। জিজ্ঞাসা হলো এর মধ্য দিয়ে কোন মানুষের বিশেষ করে চিহ্নিতকরণ? স্বতঃস্ফূর্ত জবাব, ‘বাংলাদেশে’র সন্তান যারা নাগরিক যারা সেই সব মানুষ ৷ প্রসঙ্গত আরো খেয়াল রাখতে হবে- সাধারণভাবে বাঙালি জনসৌধ তো হঠাৎ করে মাত্র বছর কয়েকেই নির্মিত হয়নি। পেছনে রয়েছে সুপ্রাচীন কাল থেকে রক্তের উত্তরাধিকার । দেশজ এবং বহিরাগত নানা এথনিক গোষ্ঠীর মানুষের বঙ্গাল বঙ্গালহ নামের এই ভূখণ্ডে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাওয়া—সবটা মিলিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের পূর্বপূরুষ এবং তাদের যূথবদ্ধতা।
তৃতীয়ত, ৭ই মার্চের ভাষণে এসেছে – বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির সাংস্কৃতিক মুক্তি’। স্পষ্টতই এই সংস্কৃতি আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। পাকিস্তানিরা তা উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছিল। ইসলামি উম্মাহর সঙ্গে রজ্জুবন্ধনের নাম করে তারা এই ষড়যন্ত্র এঁটেছিল কিন্তু বাঙালি এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে জেগে উঠেছিল। আগ্রাসনকে রুখবার এবং আপন সংস্কৃতিকে যথার্থভাবে চিনে নেয়ার জন্যে ।
চতুর্থত, ৭ই মার্চের ভাষণে উচ্চারিত হয়েছিল – বাংলাদেশের রাজনৈতিক মুক্তির দাবি । বলার অপেক্ষা রাখে না, তা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বাঙালির স্বাদেশিকতার রাজনৈতিক অধিকার অর্জন- ‘Political Independence’ প্রতিষ্ঠা। পঞ্চমত, অর্থনৈতিক মুক্তি। চব্বিশ বছরে পাকিস্তানি বণিক, শিল্পপতি শ্রেষ্ঠীরা এই দেশটিকে শোষণের উপনিবেশ ভূমিতে পরিণত করেছিল।
সর্বার্থেই এ ভূখণ্ডকে বানানো হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বার্থে অতি উর্বর বাজার। ক্রমে আমরা অধিকারসচেতন হয়ে উঠেছিলাম। ষাটের দশকে বলা হয়েছিল মুক্তর কথা। সংহত স্পষ্ট করে যা বর্ণিত হলো ‘ছয় দফা’ দাবিনামায়। তারপর এলো শৃঙ্খলিয় জীবন থেকে সর্বাঙ্গীণ মুক্তির ডাক। এই ডাকই আমাদের সামনে খুলে দিয়েছিল মুক্তির নতুন দিগন্ত। বাঙালি জাতি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুন করে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।
আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের লাইনগুলো বিশ্লেষণ করি তাহলে স্পষ্ট হয়ে যায় তিনি কীভাবে জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের। শিরোনামের বক্তব্যের মধ্যে বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনাসহ নানাবিধ নেতিবাচক বিষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অভিলাষের কথা উচ্চারিত হয়েছে।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর মহাকাব্যিক ভাষণে বাংলার মানুষকে তাঁর আকাঙ্ক্ষার কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জোরালো ভাষায় ব্যক্ত করে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিলেন। আমাদের মুক্তির সড়ক নির্মাণে তাঁর এই অনন্য দূরদর্শী ভাষণ কিংবা বক্তৃতা একটি মাইলফলক । এই বাক্যটির মাধ্যমে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তিনি দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টিকে এক প্রকারের মোটা দাগে খতিয়ে দেখে বুঝতে পারি যে, সবটা মিলিয়ে যে প্রত্যয় এরই নাম ‘৭ই মার্চ’ এবং সেই প্রত্যয়ের মহত্তম বজ্রকণ্ঠ : ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
“আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায় বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়”
লেখক : মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্লেষক
আরও পড়তে পারেন :