‘কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] মুহম্মদ জাফর ইকবাল

‘কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

পৃথিবীর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ভাষণের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আমার ধারণা, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির সাথে অন্য কোনো ভাষণের তুলনা করা সম্ভব নয় ।

‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] তোফায়েল আহমেদ
‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] তোফায়েল আহমেদ

বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণটি যখন দিয়েছিলেন তখন পুরো দেশ সামরিক শাসনের আওতায়; প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সবেমাত্র জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিল করেছেন; যে কারণে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বলতে গেলে দেশটি কার্যত অচল, যেটুকু চলছে তাও বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি নির্দেশে । পুরো দেশ একটি দিক-নির্দেশনার জন্যে অপেক্ষা করছে এবং সেই দিক-নির্দেশনাটি ৭ই মার্চ দেওয়া হবে বলে মানুষের আশা।

বঙ্গবন্ধুকে ৭ই মার্চের ভাষণটি এমনভাবে দিতে হবে যাতে পৃথিবীর সামনে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত হতে না হয়; আবার একইসঙ্গে তিনি বাঙালির প্রাণের দাবি মুক্তি এবং স্বাধীনতার কথাটি বলতে পারেন । এটি রেডিও, টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণ নয়, সরাসরি লক্ষ লক্ষ শ্রোতার সামনে দাড়িয়ে দেওয়া ভাষণ ।

৭ই মার্চের ভাষণ লিখিত নয়, স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ । সেই ভাষণের ভেতর যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, তেজ আর দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে ভালোবাসা লুকিয়েছিল সেটি আজও বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি। বাংলাদেশ যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ভাষণটি দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

৭ই মার্চের ভাষণটি সত্যিকারভাবে অনুভব করতে হলে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শুনতে হবে; তাঁর কথা বলার ভঙ্গিটি নিজের চোখে দেখতে হবে; তাঁর আবেগ, ক্রোধ, ক্ষোভ এবং বেদনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ভাষণের মর্ম উপলব্ধি করতে গেলে ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ সম্পর্কে জানতে হবে, পাকিস্তানি মিলিটারি-সৃষ্ট ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক বিভীষিকার পরিবেশটি বুঝতে হবে। কেউ যদি এই পুরো বিষয়টি অনুভব করতে পারেন তাহলে ৭ই মার্চের ভাষণটি নিশ্চিতভাবে তাঁর ভেতরে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে নতুন এক উপলব্ধির জন্ম দেবে ।

Table of Contents

পুরো দেশের, দেশের সকল মানুষের দায়ভার একা নিজের ওপর নেয়ার এরকম উদাহরণ আমার মনে হয় পৃথিবীতে খুব বেশি নেই । সেটি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতার পক্ষেই!

এই লেখার শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দুটি লাইন উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কেন এই কথাগুলো বলেছিলেন সেটি বুঝতে হলে তিনি লাইন দুটির ঠিক আগে এবং পরে কী বলেছিলেন সেটিও জানতে হবে । বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করে দেওয়ার পর ওই সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল সেটাকে প্রশমিত করার জন্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন- বঙ্গবন্ধুর সাথে টেলিফোনে তার কথা হয়েছে এবং তিনি ১০ মার্চ গোলটেবিল বৈঠকে বসতে রাজি হয়েছেন। বৈঠকে বসতে রাজি হওয়ার কথা অস্বীকার করে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে বলেন:

“জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে, কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।”

অর্থাৎ উত্তাল মার্চের বিক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তানি মিলিটারি দেশে গোলাগুলি করে যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছিল সেই হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করা পর্যন্ত, তার বিচার না করা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে কোনো গোল টেবিল বৈঠকে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর ভাষণের একটু পরেই তিনি সেটা আরো কঠিনভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব?’

Google News
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে, বঙ্গবন্ধুর বাচনভঙ্গি ছিল খুবই সহজ-সরল এবং মর্মস্পর্শী। সম্ভবত এ কারণেই তিনি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এত সহজে পৌছুতে পেরেছিলেন । মানুষকে হত্যা করার বিষয়টি কত না ভিন্ন উপায়ে বলা সম্ভব । বঙ্গবন্ধু সেটিকে বলেছেন ‘মায়ের কোলখালি করা এবং সম্ভবত এই বাক্য চয়নের জন্যেই কথাগুলো মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

এখানে একটা বিষয় কিন্তু লক্ষ করতে হবে, বঙ্গবন্ধু এই ভাষণটি দিয়েছেন মার্চ মাসের ৭ তারিখ । তখনো কিন্তু প্রকৃত গণহত্যা শুরু হয়নি । বিক্ষোভ চলছে সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে। বাঙালিদের বিক্ষোভকে দমন করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি মিলিটারি বিক্ষোভকারীদের গুলি করে মারছে। আর এই হত্যাকাণ্ডগুলোই বঙ্গবন্ধুকে বিক্ষুব্ধ এবং দুঃখভারাক্রান্ত করে তোলে। ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী সত্যিকারের গণহত্যা শুরু করে এবং সেই গণহত্যা যে পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার ইতিহাস হিসেবে পরিচিত হবে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ সেটি জানতেন না।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের একটা বিষয় লক্ষ করার মতো; তিনি কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ আর দেশকে একান্তভাবেই নিজের বলে মনে করতেন।

‘কী করে আমাদের মায়ের কোল খালি করা হয়েছে’ না বলে তিনি বলেছেন, ‘কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে।

এই দেশের দুঃখী মায়েরা ছিল তাঁর নিজের মা। তার ভাষণেই আমরা প্রমাণ পাই যে, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক।

৭ই মার্চের ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উদ্দীপক কথাগুলো হচ্ছে এর শেষ বাক্যটি, যেখানে মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা বলা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু ভাষণের মাঝামাঝি কিন্তু এই কথাগুলো আরো একবার বলেছিলেন। তখন কিন্তু আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ না বলে ‘আমার মুক্তির সংগ্রাম’ বলেছিলেন! পুরো দেশের, দেশের সকল মানুষের দায়ভার একা নিজের ওপর নেওয়ার এ রকম উদাহরণ আমার মনে হয় পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। সেটি সম্ভব হয়েছে শুধু বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতার পক্ষেই!

লেখক : মুহম্মদ জাফর ইকবাল
অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

‘কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।' [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] মুহম্মদ জাফর ইকবাল
‘কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আরও পড়তে পারেন :

Leave a Comment