‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’ – বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এর এই অংশটি নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
চাই স্বাধীনতা, চাই মুক্তি । ঘর আর বাসগৃহ নয়, দুর্গ । যা আছে তা-ই নিয়ে সম্মুখ সমরে যেতে হবে
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ বেতারে সরাসরি প্রচারিত হতে পারেনি । এর প্রতিবাদে ঢাকা বেতারের কর্মকর্তা ও কর্মীরা একযোগে ধর্মঘটে গেলে কর্তৃপক্ষ ভাষণটি সম্প্রচার করার অনুমতি দেন। ফলে, আমরা যারা তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় বাস করছিলাম, দেশের আরও কোটি কোটি মানুষের মতো, আমরাও সে ভাষণটি শুনতে পাই ৮ই মার্চে ।
ভাষণটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেহেমনে যেন তড়িৎপ্রবাহ খেলে যায়। এতকাল পরে এখনো যখন ভাষণটি শুনি, তখনো তার প্রতিক্রিয়া হয় প্রথমবারে শোনার মতোই। এটি যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ বলে গণ্য হয়েছে, তা অকারণে নয়। ভাষণটির শেষে এসে আমরা বুঝতে পারি, বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাই উচ্চারিত হয়েছে । আমরা অনুভব করি, অচিরেই পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক নতুন একটি রাষ্ট্র জন্ম নিতে যাচ্ছে ।
অর্থবহ কথায় ভাষণটি পরিপূর্ণ । বঙ্গবন্ধু জানতেন, বাংলাদেশের মানুষ তাঁর কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রত্যাশা করছে। তিনি এ কথাও জানতেন যে, একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা (UDI) করলে সামরিক বাহিনী অন্তত ঢাকাকে গুঁড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। সুতরাং অনেক কথাই তিনি পরোক্ষভাবে বলেছেন, কিন্তু সেসব প্রত্যক্ষ কথার মতোই তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে যেমন …তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে….।’ এ কথার কি আর টীকাভাষ্যের প্রয়োজন হয়? মুঘল আক্রমণের বিরুদ্ধে বারো ভুঁইয়ারা দুর্গ গড়ে তুলে যুদ্ধ করেছিলেন। এখানে কোটি কোটি নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানানো হয়েছে চূড়ান্ত সংগ্রামে অংশগ্রহণের। সেখানে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িই হয়ে উঠবে দুর্গ।
এ কথা অজানা নয় যে, মানুষের ঘরে ঘরে অস্ত্র থাকে না। তা-ই যা-কিছু আছে তা-ই নিয়ে মোকাবিলার আদেশ। শত্রু তো চিহ্নিত হয়েই আছে, লক্ষ্যও নির্ধারিত। সেই লক্ষ্যে পৌছতে হলে দরকার সংগ্রামের। সাহসিকতার সঙ্গে অবতীর্ণ হতে হবে সে-সংগ্রামে। সকলেই যদি এগিয়ে আসে শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে, তাহলে বিজয়লাভ অবশ্যম্ভাবী। ঘর যদি অভেদ্য দুর্গ না হয়ে ওঠে, মানুষের ঐক্য যেন দুর্ভেদ্য হয়। তাতেই কাজ হবে। মানুষের ইচ্ছাশক্তি, তার সমবেত চেষ্টা কত পরাক্রমশালী হতে পারে, ইতিহাসে তার সাক্ষ্য আছে। মানুষের সেই শক্তিরই আবাহন এখানে।
বাঙালি সামরিক জাতি নয় – এ ছিল ইংরেজ শাসকদের কথা। ১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধে যারা ইংরেজদের সহযোগী ছিল, তারাই কেবল এই অঞ্চলের সামরিক জাতি। বাঙালি ভীরু, বাঙালি কাপুরুষ, বাঙালি যুদ্ধ না, বিপদে তারা পলায়নপর! সেই বাঙালিকেই নেতা আহ্বান করলেন নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ পৃথিবীকে দেখিয়ে দাও, তোমরা লড়তে জানো। শত্রুকে বুঝিয়ে দাও, তোমরা অপমান সহ্য করো না। জানিয়ে দাও সবাইকে, অধিকার আদায়ে মরণপণ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হতে আমরা প্রস্তুত। সময় আসবে, যখন নেতাও পথ দেখাতে সমর্থ হবেন না, তখন পথ খুঁজে নিতে হবে, লক্ষ্যে পৌছানোর আগে বিরাম নেই।
আর কিছু না হোক, প্রাণ তো আছে আমাদের প্রত্যেকের, নিঃশেষে তাই দান করব আমরা। চাই স্বাধীনতা, চাই মুক্তি । ঘর আর বাসগৃহ নয়, দুর্গ । যা আছে তা-ই নিয়ে সম্মুখ সমরে যেতে হবে । পেছনে তাকাবার সময় নেই, ব্যর্থ হওয়ার কল্পনাও চলবে না। ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ নেই। পথ আছে সামনে, সাফল্যের গন্তব্যে চলুক অভিযান । জয় আমাদের হবেই । তার কোনো বিকল্প নেই।
[ ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] আনিসুজ্জামান
লেখক : আনিসুজ্জামান
এমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়.
ছিলেন একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন। … শিক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
আরও পড়তে পারেন :