বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী; সময়রেখা : শুধু বাঙ্গালি হিসেবেই নয়, একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী পাঠ গুরুত্বপুর্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পৃথিবীর একজন অন্যতম নেতা যিনি অনেক অসম্ভব কে সম্ভব করেছেন।
উপনিবেশ-উত্তর আমলে বাংলাদেশই একমাত্র ভূখণ্ড, যেটি নৃতাত্ত্বিক-ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার কোথাও এ ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি। আমাদের আরেক স্মরণীয় সাফল্য হলো মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে আমরা পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলাম।
আমরা এই আর্টিকেলটিতে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীকে সময়রেখায় বিভক্ত করেছি। চেষ্টা করেছি ওই সময়ের বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ যোগ করতে। আশা করি এই আর্টিকেলটিতে আপনারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল তথ্য পাবেন [ bangabandhu sheikh mujibur rahman, bongobondhu life history in bangla, bongobondhu life history in bangla language ]।
বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী; সময়রেখা
[ Timeline Biography of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, the father of the nation of Bangladesh ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী আমরা সময়রেখায় বিভাজিত উপস্থাপন করলাম । আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম
১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে (বর্তমানে উপজেলা) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম শেখ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুনের চার কন্যা (মোসাম্মৎ ফাতেমা বেগম, আসিয়া বেগম, আমেনা বেগম ও খোদেজা বেগম) ও দুই পুত্রের মধ্যে (শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ আবু নাসের) তৃতীয় সন্তান তিনি। বাবা-মা আদর করে তাকে খোকা বলে ডাকতেন। খোকার শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়। তাঁর দাদা ছিলেন শেখ আবদুল হামিদ । আর দাদার বড় ভাই শেখ আবদুল মজিদ ছিলেন তাঁর নানা।- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
শেখ মুজিব তাঁর ছোট দাদা খান সাহেব আবদুর রশিদ প্রতিষ্ঠিত টুঙ্গিপাড়ার এম ই স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেন এই স্কুলে তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পিতার কর্মস্থলে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী – এ বছর শেখ মুজিবের বিয়ে হয় তাঁর নিকটাত্মীয়া ৩ বছরের শিশু শেখ ফজিলাতুন নেছা রেণুর সঙ্গে রেণুর জন্ম শুক্রবার, ৮ আগস্ট ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ ।
দুই বোনের মধ্যে বড় বোন জিন্নাতুন নেছার ৫ বছর এবং ছোট বোন রেণুর ৩ বছর বয়সে তাদের পিতা শেখ জহুরুল হক মারা যান রেণুর পিতা ছিলেন শেখ মুজিবের সম্পর্কের চাচা। শিশু রেণুর দাদা শেখ আবুল কাশেম ভাইপো শেখ লুৎফর রহমানের সঙ্গে কথা বলে শেখ মুজিবের সঙ্গে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মার্চ, রবিবার রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বিবাহ সুসম্পন্ন করেন।
রেণুর ৫ বছর বয়সে তাঁর মা হোসনে আরা বেগম ও ৭ বছর বয়সে দাদা শেখ আবুল কাশেমের মৃত্যু হয়। এরপর শেখ মুজিবের মা শিশু রেণুকে নিজ পরিবারে নিয়ে আসেন এবং তাঁর পড়ালেখাসহ সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজিলাতুন নেছা রেণু তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ও দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানার জনক-জননী ।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর পড়ালেখায় সাময়িক বিরতি ঘটে ।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পিতার কর্মস্থল মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন । কিন্তু চোখের অসুস্থতার জন্য আবারও তাঁর পড়ালেখায় বিরতি ঘটে । তাঁর পিতা উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এখানেই ১০ দিনের মধ্যে তাঁর দুই চোখেরই অপারেশন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অপারেশন করেন নামকরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. তসাদ্দুক আহমেদ । ডাক্তরের পরামর্শ মতো এ বছর থেকেই তিনি চশমা পরা শুরু করেন। চোখের চিকিৎসার জন্য ৩ বছর (১৯৩৪, ১৯৩৫ ও ১৯৩৬) তাঁকে পড়ালেখা বন্ধ রাখতে হয়।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এ বছর সুস্থ হয়ে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পুনরায় পড়ালেখা শুরু করেন ।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এ বছর অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে আসেন। গোপালগঞ্জ সফরকালে কংগ্রেসের বাধানিষেধ সত্ত্বেও মিশন স্কুলের ছাত্র শেখ মুজিব সফলভাবে তাদের সংবর্ধনার আয়োজন করেন। তারা প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন।
এরপর হক সাহেব যান পাবলিক হল পরিদর্শনে আর সোহরাওয়ার্দী সাহেব গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শনে এলে স্কুলের ক্যাপ্টেন শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের পক্ষ থেকে স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়া ঠিক করা ও ছাত্রাবাস নির্মাণের দাবি করেন । এ সময় সোহরাওয়ার্দী সাহেব শেখ মুজিবুর রহমানের কথাবার্তায় মুগ্ধ হন এবং তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। জনাব সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবের ঠিকানা লিখে নিয়ে যান।
কিছুদিন পর তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি চিঠি লেখেন এবং শেখ মুজিব চিঠির জবাবও দেন। তখন থেকেই ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ জননেতা ব্যারিস্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পর্কের শুরু।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এ বছর শেখ মুজিবুর রহমান অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ মহকুমার সম্পাদক এবং অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা ও প্রাদেশিক কাউন্সিলর হন। এ বছর তিনি গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন ।
গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়াকালীন শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ, এমএসসি পরিচালিত ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ বাড়ি বাড়ি থেকে মুষ্টি চাউল তুলত এবং ছাত্রদের বই, পরীক্ষার ফি, জায়গিরের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য খরচ জোগান দিত হঠাৎ মাস্টার সাহেব মারা যাবার পর শেখ মুজিব ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে সমিতির কর্যক্রম অব্যাহত রাখেন খেলাধূলার প্রতি তাঁর ছিল প্রচন্ড ঝোঁক। বিশেষ করে তিনি ফুটবলের ভালো খেলোয়াড় ছিলেন কিন্তু রাজনীতিতে ব্যস্ততার জন্য খেলাধূলায় তিনি আর সময় দিতে পারেন নি।
এ বছর শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় বেড়াতে গেলে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন পরবর্তীকালে তিনি যখন কলকাতায় পড়তে গেলেন তখন জনাব সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ হয়।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এ বছর শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ওই বছরই তিনি অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা শাখার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলার সম্মেলনে খুব কাছে থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষণ, ও আবৃত্তি শোনেন তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন এবং এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
ছাত্র অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান সাহসী ও বিপ্লবী নেতা হিসেবে পরিচিত হন। এ বছর তিনি দুইবার সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার হন। তার কারণ ছিল হয় জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান অথবা সভাস্থলে গোলযোগের মধ্যে অবস্থান।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এ বছর শেখ মুজিবুর রহমান ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন এবং বেকার হোস্টেলে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এ বছরই পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন । অবশ্য এর তিন বছর আগে থেকেই এদিকে তাঁর আগ্রহ জেগে উঠে।
শেখ মুজিবুর রহমান পড়ার জন্য কলকাতায় আসার পর থেকেই জনাব সোহরাওয়ার্দীর আরও কাছের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পান এবং জনাব সোহরাওয়ার্দীকে তিনি রাজনীতির গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন ।
ছোটবেলায় (১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ) রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বিয়ে হলেও এ বছরই শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজিলাতুন নেছার ফুলশয্যা হয়।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এ বছর শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন ।
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
শেখ মুজিবুর রহমান কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগদান করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কলকাতাস্থ ফরিদপুরবাসীদের একটি সংস্থা ‘ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ বছর তিনি রশিদ আলী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন । তিনি কলকাতা থেকে বেশ কিছু সঙ্গী নিয়ে ৭-৯ এপ্রিল দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ পন্থি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের কনভেনশনে যোগদান করেন।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভোটে (৬-৭ জুলাই) তিনি প্রায় পাঁচশত কর্মী নিয়ে প্রচারকার্যে যোগ দিয়ে ব্যাপকভাবে জনসংযোগ করেন ।
১৪-১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে স্বাধীন দুইটি রাষ্ট্র গঠিত হলে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে । দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং শান্তি সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মা গান্ধী ও এইচ এস সোহরাওয়ার্দী যে তৎপরতা শুরু করেন, তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বছরের শেষ দিকে তিনি ঢাকা চলে আসেন ।
২৮ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজিলাতুন নেছার প্রথম সন্তান শেখ হাসিনার জন্ম হয় ।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা :
৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকায় তিনি নিজে কোন পদ গ্রহণ করেন নি। তবে নবগঠিত ছাত্রলীগের সকল কর্মকান্ড তিনিই পরিচালনা করতেন। এক মাসের মধ্যে তিনি পূর্ববঙ্গের প্রায় সব জেলা কমিটি গঠন করতে সক্ষম হন।
বঙ্গবন্ধুর নামে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার প্রথম ফাইল :
এই বছরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো আইবি, প্রথম ফাইল খোলে যেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ হতে শুরু করে [ 13 January 1948 watch report mentioning Sheikh Mujibur Rahman‟s name for the first-time.
The report cites the selling of a political booklet (written in Bengali) by some East Pakistan Muslim League (EPML) workers in front of the Chief Minister‟s house of the then East Pakistan, which was co-published by Sheikh Mujibur Rahman. Reports on Mujib‟s diverse political activities started to increase gradually and as a result the IB opened a personal file in his name (P.F. 606-48) in 1948 to accumulate all his information, which clearly states Mujib‟s political potentiality.]
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে (রোল-১৬৬, এস এম হল)। ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মেনে নেবে’। খাজা নাজিমুদ্দিনের এই বক্তব্যে সমগ্র পূর্ববঙ্গে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেখ মুজিব মুসলিম লীগের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্ততি গ্রহণের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন । শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে ভাষা আন্দোলনের শুরু, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন :
২ মার্চ ভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে আহূত সর্বদলীয় সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবক্রমে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ হিসেবে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগই এই আন্দোলনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
পাকিস্তানের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম গ্রেপ্তার ও কারাজীবন :
১১ মার্চ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ধর্মঘট পালনকালে ঢাকার সচিবালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান ৭০/৭৫ জন সহকর্মীর সঙ্গে গ্রেপ্তার হন। শেখ মুজিবুর রহমান সহ ছাত্র নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারে সমগ্র পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে এখান থেকেই শুরু হয় শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তার হওয়া ও কারাজীবন। মুসলিম লীগ সরকার আন্দোলনের চাপে ছাত্রদের দাবি মেনে কারাগারে আটক শেখ মুজিবসহ গ্রেপ্তারকৃত ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ৮টি শর্তে সমঝোতা করে পরিস্থিতি সামাল দেয় এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ৫ দিনের কারাবাস শেষে ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় শেখ মুজিবসহ ছাত্র নেতৃবৃন্দ মুক্তিলাভ করেন ।
১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্র-জনতার এক সভা আয়োজন করা হয়। ওই সভায় শেখ মুজিব সভাপতিত্ব করেন । সভাশেষে ছাত্রদের শোভাযাত্রা প্রাদেশিক পরিষদ অভিমুখে অগ্রসর হয়। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পেছনের দরজা দিয়ে পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন।
ছাত্রদের শোভাযাত্রার উপর পুলিশ হামলা করে। এ হামলার প্রতিবাদে ১৭ মার্চ ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে কর্ডন প্রথার বিরুেদ্ধে আন্দোলন করার জন্য শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয় ।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
২১ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্তি পান । ঢাকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট ঘোষণা করলে শেখ মুজিব তাদের প্রতি সমর্থন জানান । কর্মচারীদের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিকভাবে তাঁকে সহ ২৭ জন ছাত্রকে জরিমানা করে। আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র (রোল-১৬৬, এস এম হল) শেখ মুজিবের হয় ১৫ টাকা জরিমানা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় ১৭ এপ্রিলের মধ্যে জরিমানা এবং অভিভাবক কর্তৃক প্রত্যায়িত মুচলেকা প্রদান করতে হবে। অন্যথায় ১৮ এপ্রিল থেকে ছাত্রত্ব বাতিল হবে। ১৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি শেষ হলে এই নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। অনেকে এই অন্যায্য জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব বজায় রাখলেও শেখ মুজিব জরিমানা ও মুচলেকা দেওয়ার অন্যায় নির্দেশ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন । ফলে, ১৮ এপ্রিল থেকে তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায় অর্থাৎ তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন।
১৯ এপ্রিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করার কারণে গ্রেপ্তার হন। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং জেলে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব এ দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জুলাই মাসের শেষের দিকে মুক্তিলাভ করেন তিনি। জেল থেকে বেরিয়েই দেশে বিরাজমান প্রকট খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। সেপ্টেম্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে ফের গ্রেপ্তার হন এবং পরে মুক্তি লাভ করেন।
১১ অক্টোবর ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিবাদ সভা শেষে মিছিল বের করলে নাজিরাবাজার রেলওয়ে ক্রসিংয়ের নিকট পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে।
মাওলানা ভাসানীর অনুরোধে শেখ মুজিব গ্রেফতার এড়িয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর যান। যেহেতু তার সঙ্গে জনাব সোহরাওয়ার্দীর সুসম্পর্ক আছে তাই জনাব সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনে জনাব সোহরাওয়ার্দীকে রাজি করাতে মাওলানা ভাসানীর কথামতো শেখ মুজিব লাহোর যান। প্রায় দুই মাস সেখানে জাতীয় নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং সাংগঠনিক কর্মকান্ড শেষে লাহোর থেকে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করলে ৩১ ডিসেম্বর তিনি গ্রেফতার হন ।
১৯৫০ এবং ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারেই কাটান।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। শেখ মুজিব তখন ঢাকা জেলে বন্দি ৷ বন্দি অবস্থায় ফেব্রুয়ারিতে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এখান থেকে ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার যোগাযোগের সুযোগ হয় এবং তিনি নাজিমুদ্দিনের ঘোষণার বিরুদ্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন জোরদার করতে পরামর্শ দেন। ছাত্রদের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত বিক্ষোভের সমর্থনে এবং জেলের বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব অনশন ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। এই উদ্যোগে তাঁর সহযোগী হন আর এক রাজবন্দি পিরোজপুরের মহিউদ্দিন আহমদ ।
১৬ ফেব্রুয়ারি অনশন ধর্মঘটের ঘোষণা এবং জেলে থেকে আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়ে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমদকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।
শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে বন্দি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী যথাক্রমে নেপাল সাহা, ডা. মারুফ হোসেন, চুনিলাল চক্রবর্তী, সত্যমিত্র এবং পূর্ণেন্দু দে কানুনগো অনশনে যোগদান করলে পাকিস্তান সরকার বেকায়দায় পড়ে যায়। ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমদের স্বাস্থ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ফরিদপুর জেল কর্তৃপক্ষ সরকারের নিকট প্রতিবেদন পাঠায় ।
২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করলে শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিউর প্রমুখ শহীদ হন। ফলে, জনমনে সরকারের প্রতি ক্ষোভ বেড়ে যায়।
২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে স্বাস্থ্যের সংকটজনক অবস্থায় শেখ মুজিবকে ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় ।
২ অক্টোবর পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তিসম্মেলনে তিনি যোগদান করেন এবং বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৩ জুলাই ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের তিন দিনব্যাপী (৩-৫ জুলাই) প্রথম দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশনে অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব দলের সাংগঠনিক রিপোর্ট (সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট পেশ করেন এবং ৫ জুলাই কাউন্সিলের শেষ দিনের সকালের অধিবেশনে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়।
১৪ নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় ।
২০ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট একুশ-দফা নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করে।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৮-১২ মার্চ অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩টি আসন। এরমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ পায় ১৪৩টি আসন। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ আসনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে নির্বাচিত হন ১৫ মে শেখ মুজিব পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন তিনি ছিলেন এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্ৰী।
৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। এ দিন তিনি করাচি থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং গ্রেপ্তার হন।
১৮ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
২১ জুন শেখ মুজিব গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৭ জুন আওয়ামী লীগ ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে।
২৩ জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যরা আইনসভা থেকে পদত্যাগ করবেন।
২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে শেখ মুজিব বলেন:
“Sir, you will see that they want to place the word ‘East Pakistan’ instead of East Bengal’. We have demanded so many times that you should use Bengal instead of Pakistan, the word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted. If you want to change it then we have to go back to Bengal and ask them whether they accept it.
So far as the question of One-Unit is concerned it can come in the constitution. Why do you want it to be taken up just now? What about the state language, Bengali? What about joint electorate? What about autonomy? The people of East Bengal will be prepared to consider One-Unit with all these things. So, I appeal to my friends on that side to allow the people to give their verdict in any way, in the form of referendum or in the form of plebiscite”.
(অনুবাদ : “স্যার আপনি লক্ষ করবেন ওরা ‘পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম উচ্চারণ করছে। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন । ‘বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য । আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন । আপনারা যদি ওই নাম পরিবর্তন করতে চান, তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তন মেনে নিবে কিনা।
এক ইউনিটের প্রশ্নটা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে আপনারা এই প্রশ্নটাকে এখনই কেন তুলতে চান? বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কী হবে? যুক্ত নির্বাচনি পদ্ধতি গঠনের প্রশ্নটারই কী সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধেই বা কী ভাবছেন? পূর্ব বাংলার জনগণ অন্য প্রশ্নগুলোর সমাধানের সঙ্গে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা করতে প্রস্তুত। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাব তারা যেন আমাদের জনগণের ‘রেফারেন্ডাম’ অথবা গণভোটের মাধ্যমে রায় প্রদানের বিষয়টি মেনে নেন।”)
২২ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের তিন দিনব্যাপী (২১-২৩ অক্টোবর) কাউন্সিলের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করে নতুন নামকরণ করা হয় আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিব পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
২৯ ফেব্রুয়ারি শাসনতন্ত্র বিল গণপরিষদে পাস হয়। আওয়ামী লীগ এই বিলের পক্ষে ভোট দানে বিরত থাকে এবং আরও ১১ জন সদস্যসহ আওয়ামী লীগের ১৩ জন সদস্য গণপরিষদ থেকে ওয়াক আউট করে তাদের আপত্তি ছিল চারটি বিষয়ে –
১. জাতীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যায় প্যারিটি নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অর্থনীতি, প্রশাসন বা সামরিক বাহিনীতে এই নীতির বাস্তবায়নের পক্ষে কোন বিধান রাখা হয় নি,
২. রাষ্ট্রপতির স্ববিবেচনার ক্ষেত্র হয় বৃহৎ এবং এত ক্ষমতা সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থি,
৩. যুক্ত নির্বাচনের বিষয়টি ঝুলে থাকে এবং
৪. শাসনতন্ত্র প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে অবহেলা করে।
এপ্রিলে শেখ মুজিব স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন এবং ইউরোপ সফর শেষে তিনি ৩ মে করাচি প্রত্যাবর্তন করেন। ১৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সভায় প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন শেখ মুজিব । ৩০ আগস্ট কেএসপি-র আবু হোসেন সরকার (প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী) খাদ্যসমস্যা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয় এবং প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে অসমর্থ হয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়।
৪ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে বিরাট ভুখা মিছিল বের হয় । চকবাজার এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে ৩ জন নিহত হয় ।
৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন, কৃষি ও শিল্পোন্নয়ন, সমাজকল্যাণ এবং সমাজ উন্নয়ন পরিকল্পনা দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্বলাভ করেন।
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৪ জানুয়ারি শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিব পাকিস্তান-ভারত বাণিজ্য সম্মেলনে যোগদানের জন্য নয়াদিল্লি গমন করেন। সম্মেলন শেষে কলকাতা হয়ে ২৪ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন ।
৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় । সম্মেলনে বিদেশ নীতি নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যে মাওলানা ভাসানী দলের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং জুলাই মাসে তিনি নতুন দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। এরপর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বলাভ করেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ।
১৪ মার্চ প্রাদেশিক আইন পরিষদে শেখ মুজিব উত্থাপিত ‘কুটিরশিল্প কর্পোরেশন বিল’ পাস হয়।
২ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদে শেখ মুজিব উত্থাপিত ‘দুর্নীতি দমন বিল’ পাস হয়।
৩ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদে শেখ মুজিব উত্থাপিত ‘চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন বিল’ পাস হয়অ
ঐ দিন পরিষদে মুদ্রা, পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রের হাতে রেখে পাকিস্তান সরকারের নিকট পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় । পূৰ্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি সংবলিত প্রস্তাব গ্রহণে শেখ মুজিবের ছিল প্রধান ভূমিকা ।
৩০ মে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্য দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন ।
১৯ জুন থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত চিন সরকারের আমন্ত্রণে পাকিস্তান পার্লামেন্টারি দলের নেতা হিসাবে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল নিয়ে শেখ মুজিব গণচিন সফর করেন।
৮ আগস্ট শেখ মুজিবের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়।
১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৭ এপ্রিল শেখ মুজিব ব্রিটেন সরকারের আমন্ত্রণে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং ব্রিটেন সরকারের অতিথি হিসাবে তিনি ২ সপ্তাহ লন্ডন সফর করেন ।
২০ এপ্রিল শেখ মুজিব মার্কিন লিডারশিপ প্রোগ্রামে আমেরিকা সফরের উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করেন। এই সফরকালে তিনি জাপান ও দূরপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ সফর শেষে ৪ জুন ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।
৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১২ অক্টোবর শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন এবং একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাকে হয়রানি করা হয় ।
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৭ ডিসেম্বর নিবর্তনমূলক আটক অর্ডিন্যান্স-বলে ১৪ মাস জেলে থাকার পর শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন।
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৫ জুলাই শেখ মুজিব হাইকোর্টের রায়ে সসম্মানে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন (১৯৫৯ সালে একটি মামলায় তাঁর শাস্তি হয়)। এই মামলা পরিচালনা করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় সামরিক শাসন ও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে শেখ মুজিব গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
এ সময়ই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্র নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি মহকুমায় এবং থানায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন। এই সময় তিনি আলফা ইন্সুয়েরেন্স কোম্পানির পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষ ব্যক্তির দায়িত্ব পালন করেন
সামরিক শাসনের অধীনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকায় এবং দেশের নেতৃত্বে বাঙালিদের ভূমিকা বিলুপ্ত হওয়ায় শেখ মুজিব ক্রমেই শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং স্বাধীন বাংলার ধারণা তখন থেকেই তাঁর চিন্তাধারায় শক্ত হতে থাকে।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় ।
২ জুন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেশে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করলে চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটালেও এই অগণতান্ত্রিক সংবিধান দিয়ে তিনি স্বৈরতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করার নতুন ব্যবস্থা করেন।
১৮ জুন শেখ মুজিব মুক্তি লাভ করেন ।
২৫ জুন শেখ মুজিবসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দেন ।
৫ জুলাই পল্টনের জনসভায় তিনি আইয়ুব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।
২৪ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব লাহোর যান, সেখানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় মোর্চা- জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সমগ্র পূর্ববঙ্গ সফর করে ব্যাপকভাবে জনসংযোগ করেন।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১০-২৮ আগস্ট শেখ মুজিব লন্ডন সফর করেন। চিকিৎসার জন্য সোহরাওয়ার্দীর লন্ডনে অবস্থানকালে শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে পরামর্শের জন্য লন্ডন যান। ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে ইন্তেকাল করেন।
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাসভবনে (সড়ক: ৩২, বাড়ি: ৬৭৭) অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয় । এই সভায় দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিসহ সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সংবলিত প্রস্তাব গৃহীত হয় ।
৬-৮ মার্চ ঢাকার গ্রিন রোডের আমবাগানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ।
১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নারায়ণগঞ্জসহ প্রদেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে সম্মিলিত বিরোধীজোট কপ গঠনে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন ।
১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় অগ্রণী ভূমিকা নেয়ায় নির্বাচনের ৬ দিন পূর্বে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন।
৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুবের তথাকথিত জয় সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলবেই।”
২৩ জুন ঢাকার প্রেসক্লাবে পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনার তীব্র নিন্দা করেন এবং স্বদেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষাকল্পে পাকিস্তানবাসী বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানি জনসাধারণকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান।
২০ ডিসেম্বর শেখ মুজিব চট্টগ্রামের ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকা সফর শেষে ঢাকা ফিরে ওই এলাকার সামগ্রিক পরিস্থিতিকে জাতীয় জরুরি অবস্থার পর্যায়ে গণ্য করে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রতি যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেন।
এ বছর শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে মামলা দায়ের এবং বিচারে এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীকালে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা তুলে ধরেন । এই ছয় দফাই বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ।
উল্লেখযোগ্য যে, লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত বিরোধীদলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনি কমিটির আপত্তির কারণে তিনি সম্মেলনে তাঁর ঐতিহাসিক ছয়-দফা উত্থাপনে ব্যর্থ হয়ে সংবাদ সম্মেলনে তা প্রকাশ করেন।
১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ছয়-দফা বিস্তারিত তুলে ধরেন।
২০ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাসভবনে (সড়ক : ৩২, বাড়ি : ৬৭৭) আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিতসভায় ছয়-দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হয়।
১৯ মার্চ ঢাকার ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত দলের তিন দিনব্যাপী (১৮-২০ মার্চ) কাউন্সিলের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ ১৫ বছর সফলভাবে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তাঁর ছয়-দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে অনুমোদিত হয় ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়-দফার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষে সারা বাংলায় ব্যাপকভাবে গণসংযোগ সফর করেন। এ সময় তাঁকে যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বারবার গ্রেপ্তার করা হয়। এ বছরের প্রথম ৩ মাসে তিনি আটবার গ্রেপ্তার হন। ৮ মে শেখ মুজিব নারায়ণগঞ্জ টাউন হল ময়দানে শ্রমিক-জনতার বিশাল জনসভা শেষে বাসায় ফিরলে গভীর রাত ২ টায় (৯ মে) দেশ রক্ষা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় । এবার তিনি প্রায় ৩ বছর কারাবন্দি ছিলেন ।
৭ জুন শেখ মুজিব ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে এবং ছয়-দফার সমর্থনে সারা দেশে আওয়ামী লীগ আহূত ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সময় পুলিশের গুলিতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গি ও তেজগাঁও শিল্প এলাকায় মনু মিয়াসহ ১১ জন নিহত হয় এ দিনই ছয়-দফা বাঙালির মহাসনদে (ম্যাগনাকার্টা) পরিণত হয় ।
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারেই কাটান।
১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয় ।
১৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করে কয়েকজন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ নামে মামলা দায়ের করে, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত । শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন-বিক্ষোভ শুরু হয়।
১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসের সিগন্যাল মেসে স্থাপিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয় ।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৫ জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র ছাত্রসমাজ সম্মিলিতভাবে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। একই সঙ্গে সমুদয় রাজনৈতিক দল ঢাকায় এক অধিবেশনে গঠন করে ‘ডাক’ (Democratic Action Committee) এবং ৮ দফা দাবি ঘোষণা করে।
১৪ জানুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সম্পূর্ণ ছয়-দফা অন্তর্ভূক্ত করে ঘোষণা দেয় পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাবিষয়ক জাতীয় সনদ ১১-দফা। সরকারি দমননীতি, ১৪৪ ধারায় নিষেধাজ্ঞা জারি, লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ, ধরপাকড় ও কারফিউ গণ-অভ্যূত্থান মোকাবিলায় ব্যর্থ হয় । ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে শাহাদতবরণ করায় আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।
২৪ জানুয়ারি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস এইদিন ঢাকায় মুক্তিপাগল ছাত্র জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। সেক্রেটারিয়েটের নম্বর গেটের নিকট মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছয়জন যথাক্রমে ঢাকার বকশীবাজারস্থ নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক (১৭), শেখ রুস্তুম আলী (১৪), মকবুল (১৫) এবং অপর তিনজনের লাশ পুলিশ নিয়ে যায়।
এরমধ্যে একজনকে বেয়নেট চার্জ করা হয় এরপর ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে লাখো বাঙালি ল-স্লোগানে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দেয়। এই আন্দোলন-সংগ্রাম-গণজাগরণ গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই এইদিন ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে রূপলাভ করে।
৫ জানুয়ারি আদমজীনগর ও নারায়নগঞ্জে সেনাবাহিনীর গুলিতে দুইজন শহীদ হন।
২৬ জানুয়ারি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, আদমজীনগর ও সিদ্ধিরগঞ্জ শিল্প এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ছয়জন শহীদ হন।
২৭ জানুয়ারি পূর্ববর্তী দুইদিনে সেনাবাহিনীর গুলিতে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুইজন কিশোর মৃত্যুবরণ করে এবং ময়মনসিংহের গৌরিপুরে পুলিশের গুলিতে একজন শহীদ হন।
২৮ জানুয়ারি শেখ মুজিব ঢাকা সেনানিবাসের সিগন্যাল মেসে স্থাপিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাঁর লিখিত জবানবন্দিতে বলেন, ‘পূর্ব বাংলার ন্যায্য দাবি দাবাইয়া রাখার জন্যই এই ষড়ন্ত্র মামলা’।
১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাঁর মৌলিক গণতন্ত্রের ব্যর্থতা স্বীকার করে জাতীয় সংকট সমাধানের জন্য গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেয় কিন্তু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যেতে শেখ মুজিব অসম্মত হন।
১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে দেহরক্ষীর গুলিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত ও সার্জেন্ট ফজলুল হক গুরুতরভাবে আহত হন এবং নারায়ণগঞ্জের অদূরে সেনাবাহিনীর গুলিতে দুইজন শহীদ হন।
১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সিনিয়র রিডার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. সামসুজ্জোহাসহ তিনজন শহীদ হন।
১৯ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর গুলিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নয়জন শহীদ হন।
২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম ও গণঅভ্যুত্থানের ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ।
২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়র্দী উদ্যান) ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ প্রদত্ত গণসংবর্ধনার আয়োজন করে। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার উপস্থিতিতে এই ঐতিহাসিক গণসংবর্ধনায় সভার সভাপতি, ডাকসুর ভিপি ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জনাব তোফায়েল আহমদের প্রস্তাবে সদ্য কারামুক্ত জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে ছাত্রসমাজের ১১-দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।
২৮ ফেব্রুয়ারী রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠকের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণে ৬-দফা ও ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করে বলেন, ‘গণঅসন্তোষ নিরসনে ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৩ মার্চ তিনি গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করেন এবং ১৪ মার্চ ঢাকা ফিরে আসেন।
২৫ মার্চ সেনাপ্রধান লে. জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন।
২৫ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তিন সপ্তাহের সাংগঠনিক সফরে লন্ডন গমন করেন এবং ৮ নভেম্বর তিনি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।
৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মৃত্যুবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। তিনি বলেন:
‘এক সময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে ।…একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১১ জানুয়ারি পল্টনের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম ‘সোহরাওয়ার্দী পার্ক’ এবং দ্বিতীয় রাজধানীর নাম আইয়ুব নগরের পরিবর্তে ‘শেরেবাংলা নগর’ নামকরণ ঘোষণা করেন।
১ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৫ জুন ঢাকার ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী (৪ ও ৫ জুন) প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন।
৬ জুন ঢাকার ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন ।
৭ জুন রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬-দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
১৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের নির্বাচনি প্রতীক হিসেবে ‘নৌকা’ প্রতীক নির্ধারণ করেন এবং ঢাকার ধোলাইখালে প্রথম নির্বাচনি জনসভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন ।
২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে বেতার-টিভিতে প্রদত্ত ভাষণে ৬-দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করবার জন্য দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানান।
১২ নভেম্বর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস (গোর্কিতে) উপকূলীয় এলাকায় ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটলে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনি প্রচারণা বাতিল করে দুর্গত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেন এবং আর্তমানবতার প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের ঔদাসিন্যের তীব্র সমালোচনা জানিয়ে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন । তিনি গোর্কি উপদ্রুত মানুষের ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান ।
৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩০০। আর সংরক্ষিত মহিলা আসন ১৩ । পূর্ব পাকিস্তান অংশে জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে বিজয়ী হয়ে সংরক্ষিত ১৩টি মহিলা আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান অংশে ৭টি মহিলা আসনের সবকটি পায় আওয়ামী লীগ। জাতীয় পরিষদে সর্বমোট ১৬৭টি আসন পায় আওয়ামী লীগ।
১০ ডিসেম্বর লন্ডনের দ্য টাইমস পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব বাংলার ‘মুকুটহীন সম্রাট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
১৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের আসন সংখ্যা ৩০০। সংরক্ষিত মহিলা আসন ১০ । প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে বিজয়ী হয়ে ১০টি মহিলা আসনসহ ২৯৮টি আসন পায় আওয়ামী লীগ।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী; সময়রেখা
৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগদলীয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখার শপথ গ্রহণ করেন।
৫ জানুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তাঁর সম্মতির কথা ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৭ জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন তিনদিন বৈঠকের পর আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়
১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের নেতা নির্বাচিত হন এবং যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বময় ক্ষমতা লাভ করেন ।
১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ: রাজনীতির মহাকাব্য । ১৮২
প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান।
১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে জনাব ভুট্টোর দাবির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।’
১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এ দিন বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়
৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবি জানান এবং বিকেলে পল্টন ময়দানের উত্তাল-উদ্দাম জনসমুদ্রে ছাত্রলীগের ঘোষিত প্রস্তাবাবলিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ ও ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
৭ মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্সের মহাজনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির প্রতি শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। তিনি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রস্তুতি নিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো । যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি প্রকাশ্য হয়ে যায় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণের মানসিক দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে যায় । বঙ্গবন্ধু শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান । তিনি ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ধানমণ্ডি ৩২ নং সড়ক থেকে ঘোষিত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পূর্ব বাংলার মানুষ মেনে চলতেন । অফিস, আদালত, ব্যাংক, বিমা, স্কুল-কলেজ, গাড়ি, শিল্প-কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মূলত, ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।
১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয় ।
২১ মার্চ আলোচনার জন্য জনাব ভুট্টোও ঢাকায় আসেন ।
২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয় ।
২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন।
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টারসহ সারা ঢাকা শহর, বিভাগীয় ও জেলা শহরসমূহে।
বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে (২৬ মার্চ প্রথম প্রহর) বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন :
This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours’.
[অনুবাদ: ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন । বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে ।’]
এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়ারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয় । এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত একটি ঘোষণা পাঠান:
‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা, ইপিআর ঘাটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।
সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান।
কোনো আপস নাই। জয় আমাদের হবেই । পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন । জয় বাংলা।”
হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ্রগ্রহণের জন্য বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক যোদ্ধা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বেতার যন্ত্র মারফত তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারাদেশে পাঠানো হয়। রাতেই এই বার্তা পেয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচার করা হয় গভীর রাতে।
২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২নং বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং এরপর তাঁকে বন্দী অবস্থায় পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৬ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ও বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে। সন্ধ্যার সময় কালুরঘাট বেতার উপকেন্দ্র চালু হলে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি কলেজের প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম সন্দ্বীপ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদ পাঠ করেন।
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন ।
২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় প্রধান মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার উপকেন্দ্র থেকে আরও একবার পাঠ করেন।
৫ এপ্রিল আমেরিকার বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক ‘নিউজউইক’ পত্রিকা প্রচ্ছন প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি‘ অভিধায় ভূষিত করে।
১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়।
১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (বঙ্গবন্ধুর নাম অনুযায়ী মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। নবগঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত ২৬ মার্চকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস নির্ধারণ করে।
৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। শুরু হয় মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত অভিযান।
৭ ডিসেম্বর নেপাল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমাণ্ডের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়।
৩০ লাখ বাঙালির রক্ত ও প্রায় ৫ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
১১ আগস্ট পাকিস্তানের লায়লপুর জেলে স্থাপিত সামরিক আদালতে গোপনে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু করে ।
৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। সামরিক আদালতের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বিচারকের মধ্যে একমাত্র বেসামরিক সদস্য অনুপস্থিত থাকে। বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসাবে স্থানান্তর করা হয় মিয়ানওয়ালি জেলে। সেখানে গোপনে এই দণ্ডাদেশ কার্যকরী করার পদক্ষেপও নেওয়া হয় তবে, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় । বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায় ।
২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয় ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয় ‘শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাঁকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অবদান অবিস্মরণীয় । এদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়াকে পদচ্যুত করে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক নিযুক্ত করা হয় । ভুট্টো নিউইয়র্ক থেকে প্রত্যাবর্তন করে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের মসনদে বসে ২৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে একটি বিশ্রামাগারে নিয়ে যান এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী; সময়রেখা
৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বিশ্বসাসীর চাপে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডনে পাঠানো হয় ।
৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন এবং ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে এক ঘন্টা স্থায়ী এক বৈঠকে মিলিত হন ।
৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশে ব্রিটিশ বিমানে লন্ডন ত্যাগ করেন।
১০ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেন। নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। এরপর দিল্লী ক্যান্টনমেন্টের প্যারেড ময়দানে বঙ্গবন্ধুকে প্রদত্ত বিশাল সংবর্ধনাসভায় তিনি ভাষণ দেন। এরপর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
১০ জানুয়ারি দুপুরে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় পৌছিলে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রমনা রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে জনতার মহাসমুদ্রে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। এরপর তিনি ধানমন্ডিতে তাঁর পরিবারের কাছে যান ।
১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় “বাংলাদেশ অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক আদেশ, ১৯৭২’ জারি করেন।
১২ জানুয়ারি সকাল ১১ টায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনের লাউঞ্জে বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে বিচারপতি এএসএম সায়েমকে বাংলা ভাষায় শপথবাক্য পাঠ করান।
১২ জানুয়ারি অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
১৩ জানুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে জাতীয় পতাকা (সংশোধিত), জাতীয় সংগীত (আমার সোনার বাংলা) ও কুচকাওয়াজ সংগীত (চল্ চল্ চল্)-এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এবং বীর শহীদানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ১৬ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীন সোনার বাংলায় সরকারিভাবে জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
১৪ জানুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বঙ্গবন্ধু প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “যে-কোন বিদেশি সাহায্য শর্তহীন হতে হবে এবং তিনি বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসাবে গঠন করতে চান”।
১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সকল মুক্তিযোদ্ধাদের ১০ দিনের মধ্যে তাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু কলকাতা সফর করেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘পরিবার পিছু একশত বিঘার বেশি জমি রাখা চলবে না।’
২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রতি আবেদন জানান, ‘নির্যাতিত মা-বোনদের সমাজে টেনে নিন।’
২৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান।
১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে ।
১৯ মার্চ ঢাকায় বঙ্গভবনের দরবার হলে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী স্ব-স্ব দেশের পক্ষে ২৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন ।
৩০ মার্চ বঙ্গবন্ধু বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আহ্বান জানান, ‘আমলা নয় মানুষ সৃষ্টি করুন।’
১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়। এ দিন বাংলাদেশ গণপরিষদের ঐতিহাসিক উদ্বোধনী অধিবেশনে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “শাসনতন্ত্রে গণ অধিকার স্বীকৃত হবে । ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়ন কমিটিসহ চারটি কমিটি গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু অধিবেশনের সমাপ্তি ভাষণে বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্যই বিরোধীদল থাকা উচিত।’
১ মে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে বেতার-টিভিতে প্রদত্ত ভাষণে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। এর মধ্য দিয়েই ‘মে দিবস’ বাংলাদেশে জাতীয় দিবসের মর্যাদা লাভ করে। জাতির উদ্দেশে বেতার-টিভিতে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। এ দিনকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা
৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) বঙ্গবন্ধুকে আজীবন সদস্যপদ প্রদান করে । এ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন।
২৪ মে ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০/বি নম্বরের একটি দ্বিতল বাড়িতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে সদ্য আগত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে আন্তরিকভাবে শুভেচ্ছা জানান বঙ্গবন্ধু । এ সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা, দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ।
৩০ জুলাই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর পিত্তকোষের অস্ত্রোপচার করা হয় । লন্ডন থেকে তিনি জেনেভা সফর করেন।
১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বশান্তি পরিষদ ‘জোলিও-কুরি’ পদক প্রদানের ঘোষণা দেয় ।
৪ নভেম্বর গণপরিষদে সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ (৭ মার্চ ১৯৭৩) ঘোষণা করেন।
২৩ নভেম্বর মস্কোর প্যাট্রিক লুমুম্বা মেত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য অধ্যাপক ড. ভ্লাদিমি এফ স্তানিশ গণভবনে বঙ্গবন্ধুকে প্যাট্রিক লুমুম্বা মেত্রী বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিলের একটি বিশেষ পদকে ভূষিত করেন।
২৫ নভেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এক বিশেষ সভায় বঙ্গবন্ধুকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লিটারেচার’ ডিগ্রি প্রদানে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন।
১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের ঘোষণা দেয়।
১৬ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান কার্যকর হয় এবং এ দিন বঙ্গবন্ধু মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদানকারী বীর শহীদদের স্মরণে সাভারে স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন অপরাহে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয় দিবসের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ‘বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স” সহ সকল কালাকানুন বাতিল ঘোষণা করেন।
১৭ ডিসেম্বর সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীগণ ও প্রধান বিচারপতি শপথ গ্রহণ করে ।
২২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু মিরপুরে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদানকারী বীর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন করেন।
প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন, ভারত ফেরত এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হয়।
মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড়সহ সমস্ত ইসলামবিরোধী কর্মকান্ড কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরণ; ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, ১১,০০০ প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ ৪০,০০০ প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ, দুস্থ মহিলাদের কল্যাণের জন্য নারী পুনর্বাসন সংস্থা ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেন।
২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ, বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের পরিত্যাক্ত ব্যাংক, বিমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান করেন।
ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্পকারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যার মোকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী; সময়রেখা
৭ মার্চ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসন লাভ করে।
১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নয়া মন্ত্রিসভা শপথগ্রহণ করে।
৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ঐতিহাসিক উদ্বোধনী অধিবেশনে “বলিষ্ঠ সংসদীয় ঐতিহ্য স্থাপনের সংকল্প ঘোষনা করেন”।
২৩ মে বঙ্গবন্ধু ঢাকার শেরেবাংলা নগরে বিশ্বশান্তি পরিষদ কর্তৃক ‘জোলিও কুরি’ পদকে ভূষিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বের সকল শান্তিকামী শক্তি সুসংহত হোক।’
৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের শান্তির প্রতিশ্রুতি সর্বাত্মক ।’
৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়।
৮ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন “আমরা বিশ্বের প্রগতিশীল শক্তিসমূহের সংহতির এবং নির্যাতিত জনগণ ও তাদের ন্যায়ের সংগ্রামের সমর্থকদের সপক্ষে”।
১৭-২৪ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জাপান সফর করেন। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ খেতাব যথাক্রমে ক. বীরশ্রেষ্ঠ, খ. বীরউত্তম, গ. বীরবিক্রম ও ঘ. বীরপ্রতীক প্রদানের তালিকা গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়
১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনেক দেশি-বিদেশি সাহিত্যিকদের মিলনমেলা সপ্তাহব্যাপী জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মূল্যবোধের এই সংকট কাটাতেই হবে ।’
২২ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি প্রদান করে।
২৩ ফেব্রুয়ারি ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে (ওআইসি) যোগদানের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে গমন করেন এবং শীর্ষ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ধ্বংস নয় সৃষ্টি, যুদ্ধ নয় শান্তি ।’
১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশের প্রথম সামরিক একাডেমি’ উদ্ধোধন করেন ।
১৬ মে নয়াদিল্লিতে বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ঐতিহাসিক বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন ।
৭ জুন শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কুদরাত-এ-খোদার নিকট থেকে কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট গণভবনে জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রহণ করেন।
১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।
২৫ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন।
১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন ।
৩ অক্টোবর ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু ওয়াশিংটন থেকে বাগদাদ যাত্রা করেন ।
১৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীদের উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য দুঃস্থ শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীদের কল্যাণার্থে সরকার ‘বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ গঠন করে।
দেশে ভয়াল বন্যায় ফসল উৎপাদনে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা খাদ্যের জাহাজ সময়মতো না আসার ফলে দেশে মারাত্মক খাদ্যসংকট দেখা দেয়। দেশে কালোবাজারি, দুর্নীতি বেড়ে যাবার কারণে সার্বিক সংকট উত্তরণে জাতীয় রাজনীতির পরিবর্তনে বঙ্গবন্ধু নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন ।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী; সময়রেখা
২৫ জানুয়ারি শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্পসময়ের জন্য রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । এ দিন সকালে সংসদনেতা বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে বিদায়ী ভাষণে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন
২৬ জানুয়ারি জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ও এম মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদে ১৭ জন মন্ত্রী ও ৯ জন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগদান করেন ।
১৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে মন্ত্রী-এমপিদের সম্পত্তির হিসাব দেওয়ার যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৮ মার্চ টাঙ্গাইলের কাগমারিতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজকে সরকারিকরণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘দ্বিতীয় বিপ্লবে’র প্রতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর সমর্থন ঘোষণা করেন। ২২ মার্চ রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বেতারকর্মীদের মধ্য থেকে বাংলাদেশের ১৮ জন ও ভারতের ৪ জনসহ মোট ২২ জনকে ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক’ প্রদান করা হয়। এ দিন অপরাহে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
১৮ এপ্রিল ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে ও অনুমোদনে বাংলাদেশ-ভারত পানিচুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশ ফারাক্কা থেকে শুষ্ক মওসুমে ৪৪ হাজার থেকে ৪৯ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করে।
৩ মে জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টনে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
৬ জুন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)-এর কার্যনির্বাহী কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি ও গঠনতন্ত্র এবং ৫টি অঙ্গসংগঠনের কমিটি ঘোষণা করেন।
১৯ জুন বঙ্গভবনের দরবার হলে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে’র কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “বিদেশ হইতে আমদানি করা ‘ইজম’ বা ‘সিস্টেম’ নহে, দেশের মাটির সাথে সংযোগ রাখিয়াই শোষণহীন সমাজ গড়িব ।”
২২ জুন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশে নয়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে ৬১টি নতুন জেলার নাম ও জেলার অন্তর্ভুক্ত থানার নাম সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
১৬ জুলাই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু নবগঠিত জেলার গভর্নরদের নাম ঘোষণা করেন ।
২১ জুলাই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনের দরবার হলে নবনিযুক্ত গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য দুঃস্থ ক্রীড়াবিদদের কল্যাণার্থে সরকার ‘বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ গঠন করে।
৯ আগস্ট জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চালনা বন্দরে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণার্থে ‘চালনা বন্দর শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করেন।
ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হয়ে উন্নত বাঙালি জাতি ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অর্থাৎ স্বনির্ভর দেশ গঠনে জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদিকে যেমন অর্থনৈতিক মুক্তির যুগান্তকারী কর্মসূচি দেন, অন্যদিকে এই নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থ হন।
জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ জোটনিরপেক্ষ সংস্থা, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ অর্জনসহ বাঙালি জাতির ও বাংলাদেশের যত অর্জন তার সবই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচক্ষণ ও ত্যাগী নেতৃত্বেই অর্জিত হয় ।
সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু অভূতপূর্ব সাড়া পান। অতিঅল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায় । চোরাকারবারি বন্ধ হয় । দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় চলে আসে। নতুন উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতার সুফল দেশের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সে সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ও হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম :
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৯ শ্রাবণ ১৩৮২ বঙ্গাব্দ, ৬ শাবান ১৩৯৫ হিজরি, শুক্রবার খুব ভোরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী কতিপয় বিশ্বাসঘাতক ক্ষমতালিপ্সু অফিসারদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা, জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ কামাল, মেজ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভ্রাতুষ্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার ব্রিগেডিয়ার জামিলউদ্দিন আহমেদ, পুলিশ কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান এবং ১৪ বছরের কিশোর আবদুল নঈম খান রিন্টুসহ ১৭ জনকে ঘাতকরা নৃশংসভাবে হত্যা করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা রেণু দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলের জনক-জননী। বিদেশে থাকায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান।
মোশতাক আহমদ অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল :
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমদ অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে। এই অবৈধ সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা করে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয় এবং দেশে এক ধরনের হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি সেনাবাহিনীর কতিপয় মেজর মেশিনগান তাক করে উদ্দেশ্যহীনভাবে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নেয় এবং তাদের নেতৃত্ব দেয় মিরজাফর খন্দকার মোশতাক ।
জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান নিয়োগ:
২৪ আগস্ট খন্দকার মোশতাক জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল সফিউল্লাহর জায়গায় নিযুক্ত করেন। জেনারেল জিয়া মেজরদের ক্ষমতা হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন এবং এইসব মেজররা তাদের ট্যাংকে বসে কামান উঁচিয়ে দেশটাকে যেন সামরিক দখলে রাখার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি:
২৬ সেপ্টেম্বরে খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার থেকে রেহাই দিয়ে একটি সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে ।
জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যা, জেল হত্যা :
৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ এই হযবরল অবস্থা উত্তরণে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু মেজররা দেশত্যাগের প্রাক্কালে খন্দকার মোশতাকের হুকুমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ৪ জাতীয় নেতাকে (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান) নৃশংসভাবে হত্যা করে ব্যংকক চলে যায়।
৪ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার পদত্যাগপত্র আদায় করে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
৫ নভেম্বর সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ অবৈধ সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন করেন।
৭ নভেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি বিদ্রোহের নামে সেনানিবাসে এক নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির মধ্যে জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও তার কয়েকজন সহকর্মীকে হত্যা করে জেনারেল জিয়াকে আবার সেনাপ্রধান নিযুক্ত করে। ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে অবৈধ উত্থানের পেছনের শক্তি ছিল সেনাবাহিনীর তৎকালীন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মেজর জিয়া।
মেজর জিয়ার সম্মতি নিয়ে উচ্চাভিলাষী মেজররা ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে মেনে নিয়ে তিনি এবং নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানগণ ডেপুটি সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন । জেনারেল জিয়া এই সুযোগে তার অবস্থান শক্ত করেন ।
জেনারেল জিয়ার প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দখল :
২৮ নভেম্বর ১৯৭৬ সাল, বিচারপতি সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে বিতাড়িত করে জেনারেল জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।
জেনারেল জিয়ার রাষ্ট্রপতির পদ দখল :
২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সাল, এবার বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকেও সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতির পদও নিয়ে নেন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে তার বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রায় ২১/২২টি সেনাবিদ্রোহ দমনের নামে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সৈন্যদের হত্যা করেন। এমনকি যে কর্নেল তাহের তাকে সেনাপ্রধানের দায়িত্বে পুনর্বহাল করেন তিনি তাকেও সামরিক আদালতে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেন ।
জেনারেল জিয়া’র ‘হ্যা’ বা ‘না’ ভোট:
৩০ মে ১৯৭৭ সাল জেনারেল জিয়া তার প্রতি জনগণের আস্থা প্রমাণের জন্য দেশব্যাপী একটি মেকি রেফারেন্ডাম অর্থাৎ ‘হ্যা’ বা ‘না’ ভোটের আয়োজন করে রাষ্ট্রপতি পদে তার অবস্থানের বৈধতা দেওয়ার আয়োজন করেন ।
৩ জুন ১৯৭৮ সাল, জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান হিসেবেই অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন এবং ১ ডিসেম্বর সেনাপ্রধান হিসেবে এরশাদকে নিযুক্ত করেন। তিনি তার নবগঠিত দলের ১৯ দফা কর্মসূচি দেন ।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সাল জেনারেল জিয়া বিশেষ ব্যবস্থায় একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেরও আয়োজন করেন। এই নির্বাচনে তিনি আগেই ঠিক করে দেন যে, কারা নির্বাচিত হবেন আর কারা পরাজিত হবেন। এই নির্বাচনে ৩৯ জন আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচিত হন । আর ১৯৭১ সালের মৃত মুসলিম লীগ পায় ২০টি আসন। তার ব্যবস্থায় ব্যালট বাক্স ছিনতাই বা গুম করা এবং ব্যালট বাক্সে ইচ্ছামতো ভোট দিয়ে পূরণ করা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা ।
জেনারেল জিয়া নির্বাচন পদ্ধতিকে একটি জালিয়াতির কৌশলে পরিণত এবং নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারেই ধ্বংস করে। এই নির্বাচনে তার দল ২০৭টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে ।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে ইনডেমনিটি আইন এ পরিণত করা:
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার থেকে অব্যাহতি দিয়ে খন্দকার মোশতাকের জারি করা অধ্যাদেশকে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে ইনডেমনিটি আইনে পরিণত করে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া আইনের শাসনকে যেমন জলাঞ্জলি দেন, তেমনই ১৯৭১ সালের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রপরিচালনায় সঙ্গী করে এবং রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পবিত্র আত্মত্যাগের প্রতি করেন চরম অবমাননা। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন ।
৩০ মে ১৯৮১ সাল, রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তার সহকর্মী সেনাদের হাতে নিহত হন। এরপর রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার।
২৪ মার্চ ১৯৮২ সাল, সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন।
২৭ মার্চ ১৯৮২ সাল, বিচাপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করে জেনারেল এরশাদ প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন ।
১০ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল, এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন।
২১ মার্চ ১৯৮৫ সাল জেনারেল এরশাদও তার প্রতি জনগণের আস্থা প্রমাণের জন্য একটি মেকি রেফারেন্ডাম অর্থাৎ ‘হ্যা’ বা ‘না’ ভোটের আয়োজন করেন।
৭ মে ১৯৮৬ সাল এবং ৩ মার্চ ১৯৮৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেরও আয়োজন করেন। অর্থাৎ তার পূর্বসূরি জিয়ার পদাঙ্ক হুবহু অনুসরণ করে রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এরশাদও তার নবগঠিত দলের ২১-দফা কর্মসূচি দেন।
৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সাল গণঅভ্যুত্থান দিবস। এ দিন রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় হন তিনজোটের রূপরেখার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে।
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সাল, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে বিএনপি তিনজোটের রূপরেখার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করলে শুরু হয় গণ-আন্দোলন। এদিকে ১৯৭১ ও ১৯৭৫ সালের খুনিদের সঙ্গে নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের লেবাসে দেশ শাসন করে।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সাল, ভোটার বিহীন নির্বাচনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে বিএনপি মার্চ মাসেই রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয় ।
১২ জুন ১৯৯৬ সাল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার পুনরুদ্ধারে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠা কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করার সুযোগ পায় ।
বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠা কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন :
২৩ জুন ১৯৯৬ সাল, ২১ বছর পর বঙ্গবভনের দরবার হলে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠা কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
১৫ আগস্ট হত্যা মামলার কার্যক্রম শুরু:
২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় জনাব মুহিতুল ইসলাম তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যগণকে হত্যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন’ বাতিল করা হয় ।
১৫ জানুয়ারি ১৯৯৭ সাল, আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ সাল, অভিযুক্ত গ্রেপ্তারকৃতদের মুখ্য মহানগর আদালতে হাজির করা হয়।
১ মার্চ ১৯৯৭ সাল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড মামলা ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয় ।
৩ মার্চ ১৯৯৭ সাল, পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সন্নিকটে বিশেষ এজলাস গঠন করা হয়।
১২ মার্চ ১৯৯৭ সাল, দেশের প্রচলিত আইনে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সন্নিকটে বিশেষ এজলাসে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। বিচারক কাজী গোলাম রসুল। বিশেষ পিপি এডভোকেট সিরাজুল হক।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড মামলায় আসামি ছিল ২৪ জন। ৪ জন আসামি মারা যাওয়ায় (১.খন্দকার মোশতাক আহমদ, ২. মাহবুব আলম চাষি, ৩. ক্যাপ্টেন মোস্তফা ও ৪ রিসালদার সৈয়দ সারওয়ার হোসেন) এবং ১ জন আসামি (জোবায়দা রশিদ) হাইকোর্ট থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় ১৯ জন আসামির শুনানি শুরু হয় ।
৭ এপ্রিল ১৯৯৭ সাল, আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় ।
১৫ আস্ট হত্যা মামলার রায়:
৮ নভেম্বর ১৯৯৮ সাল, ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল দীর্ঘ শুনানি শেষে ১৭১ পৃষ্ঠাব্যাপী রায় ঘোষণায় ১৫ জনকে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
খালাসপ্রাপ্ত ৪ জন হলো :
১. তাহেরউদ্দিন ঠাকুর
২. অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব জোয়াদার
৩. দফাদার মারফত আলী শাহ
৪. এলডি আবুল হাশেম মৃধা।
১১ নভেম্বর ১৯৯৮ সাল, হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য পাঠানো হয়।
৩০ মার্চ ২০০০ সাল, হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত হয়। ১০ এপ্রিল এক বিচারপতি মামলা শুনতে বিব্রতবোধ করেন। ২৪ এপ্রিল হাইকোর্টোর অপর দ্বৈত বেঞ্চও বিব্রতবোধ করেন । ২ মে ১১ জন পলাতক আসামির পক্ষে রাষ্ট্র আইনজীবী নিয়োগ করে ।
৩ মে সংশোধিত পেপারবুক তৈরির আবেদন নাকচ করে সম্পূরক পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। ২৮ জুন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের উপর শুনানি শুরু হয়। ১০ জুলাই সম্পূরক পেপারবুক আদালতে জমা হয় । ১৮ জুলাই পেপারবুক পাঠ শেষে রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।
১৪ ডিসেম্বর ২০০০ সাল, হাইকোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে আপিলের দুই বিচারক দ্বিমতে বিভক্ত রায় ঘোষণা করেন। বিচারপতি এম রুহুল আমিন ১৫ জনের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
১৪ জানুয়ারি ২০০১ সাল, দুই বিচারপতির বিভক্ত রায় নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হয়। ১৫ জানুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে তৃতীয় বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় বিচারপতির আদালতে শুনানি শুরু হয় এবং ১৯ এপ্রিল শুনানি শেষ হয়।
৩০ এপ্রিল ২০০১ সাল, তৃতীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় প্রদান করেন। খালাসপ্রাপ্ত ৩ জন হলো : ১. ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম, ২. ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন ও ৩. মেজর আহমদ শরিফুল হোসেন। ১৬ আগস্ট মামলাটি আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ছিল । এরপর ৮ বার শুনানি মুলতুবি হয় ।
১ অক্টোবর নির্বাচনে বিএনপি-জামাত সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সাল, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি শুনানি আপিল বিভাগের কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ১৯ মার্চ বিশেষ পিপি এডভোকেট সিরাজুল হক মামলাটি শুনানি শুরুর আবেদন জানালে আপিল বিভাগের দুইজন বিচারপতি বিব্রতবোধ করেন। ফলে শুনানির জন্য বিচারপতি সংকট সৃষ্টি হয় । ১৫ ডিসেম্বর এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌসুলীদের অব্যাহতি দেয় বিএনপি-জামাত জোট সরকার ।
২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
২ আগস্ট ২০০৭ সাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধান বিচারপতি লিভ টু আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেন। বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন বিচারপতি জয়নুল আবেদিন ও বিচারপতি মোহাম্মদ হাসান আমীন । ৭ আগস্ট আসামিদের লিভ টু আপিল শুনানি শুরু হয়।
২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সাল, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠা কন্যার নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কার্যক্রম গতিলাভ করে।
৪ অক্টোবর ২০০৯ সাল, প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমীন আপিল শুনানির জন্য বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে ৫ বিচারপতির সমন্বয়ে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন। ৫ অক্টোবর আসামিপক্ষের আইনজীবীদের আপিলের উপর শুনানি শুরু হয় ।
১৯ নভেম্বর ২০০৯ সাল, ২৯ দিন শুনানির পর ৫ জন বিচারপতি রায় ঘোষণায় ৫ আসামির আপিল ও জেল আপিল খারিজ করে দেয় ।
৩ জানুয়ারি ২০১০ সাল, ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আবদুল গফুর ৫ আসামির মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেন । ৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন আসামি বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও মুহিউদ্দিন (আর্টিলারি)। ১০ জানুয়ারি আসামি বজলুল হুদা ও মহিউদ্দিনের আইনজীবী রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। ১২ জানুয়ারি আসামি সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের আইনজীবী রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। ১৯ জানুয়ারি রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান ও মুহিউদ্দিন (আর্টিলারি)।
প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে ৪ বিচারপতির বেশেষ বেঞ্চ ২৪, ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ শেষে ২৭ জানুয়ারি আদেশ দেন । সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় পুনর্বিবেচনার সব আবেদন খারিজ করা হয় । অন্যদিকে প্রাণভিক্ষার আবেদনও নাকচ হয়ে যায় ।
২৮ জানুয়ারি (প্রথম প্রহর) মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কারাগারে আটক ৫ ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় আংশিক বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হলো ।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া ৫ জন :
১. লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান
২. লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ
৩. লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি)
৪. মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার)
৫. মেজর বজলুল হুদা।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ৭ জন :
১. লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ
২. রিসালদার মোসলেহউদ্দিন ওরফে মোসলেমউদ্দিন
৩. লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম
৪. লে. কর্নেল এম এ রাশেদ চৌধুরী
৫. লে. কর্নেল এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী
৬. লে. কর্নেল মো.আবদুল আজিজ পাশা (পলাতক অবস্থায় ২০০২ সালে মারা যায়) ও
৭. ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যার ২১ বছর পর বিচারকার্য শুরু হয় এবং ১৩ বছর সময় লাগে মামলা চূড়ান্তভাবে শেষ করতে অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর বিচারের রায় আংশিকভাবে কার্যকরী হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারক ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল । মামলার বাদী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী জনাব মুহিতুল ইসলাম। তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আকন্দ। সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী এডভোকেট সিরাজুল হক। এডভোকেট হকের মৃত্যুর পর তার পুত্র এডভোকেট আনিসুল হক সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন। এই দিবসটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে বাঙালি জাতি পালন করে।
আরও দেখুন: