বাংলাদেশের সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী এবং আরও গণতান্ত্রিক করার প্রস্তাব

বাংলাদেশের সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী এবং আরও গণতান্ত্রিক করার প্রস্তাব [ ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ] :

১। ২৭শে জানুয়ারী (১৯৯৩) তারিখে রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, বিভাগীয় দুটো শহর খুলনা ও রাজশাহী — এই চারটি সিটি কর্পোরেশন বাদে দেশের অন্যান্য জেলা শহরের পৌরসভাগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ইতিপূর্বে ১৯৯২ সালের ৯ নম্বর আইনের মাধ্যমে *পৌরসভা অর্ডিন্যান্স (১৯৭৭)’-এর সংশোধন করেন। এই ‘পৌরসভা সংশোধন আইন (১৯৯২)’-এর মাধ্যমে দেশের প্রতিটি পৌরসভার মেয়াদ পূর্বের ৩ বছরের পরিবর্তে ৫ বছরে বর্ধিত করা হয়।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী এবং আরও গণতান্ত্রিক করার প্রস্তাব এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ]
এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ]
প্রতিটি পৌরসভার প্রধান, চেয়ারম্যান’ সেই পৌরসভার এখতিয়ারভুক্ত নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের সার্বজনীন সরাসরি ভোটে এবং ‘কমিশনারদের’ তাঁদের স্ব স্ব আসনের জন্য নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের ভোটারদের সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত করার বিধিবিধান রয়েছে ১৯৭৭ সালের পৌরসভা অর্ডিন্যান্স’-এ। ‘পৌরসভা সংশোধন আইন (১৯৯২)’-এ ঐ সমস্ত বিধিবিধানের কোন সংশোধন করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ সালে দেশে যেখানে জাতীয় পর্যায়ে সংসদীয় মন্ত্রিপরিষদ পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয় অর্থাৎ রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী প্রধান বা সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে সাংসদদের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন-ভোটে নির্বাচিত হন, সেখানে ক্ষুদ্র দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী ‘পৌরসভার চেয়ারম্যানদের ১৯৯১-এর ১৫ই সেপ্টেম্বর-পূর্ব রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির ব্যবস্থায় নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা কেন রাখা হলো সে সম্পর্কে নানান প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

কারণ, ভোটারদের সরাসরি ভোটে পৌরসভার চেয়ারম্যানের’ নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থায় উক্ত পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রত্যেক প্রার্থীকে প্রচুর অর্থকড়ি ও সময়-শক্তি ব্যয় করতে হয়। সে কারণে এই পদ্ধতিতে নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের অনেকের মধ্যে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণের প্রবণতার উদ্রেক হওয়ার আশংকা থাকে। তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

‘পৌরসভা’ সংস্থার ব্যাপারে আরও একটি প্রশ্ন ওঠে। তা হচ্ছে, পৌরসভায় মহিলাদের জন্য সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট সংখ্যক সংরক্ষিত মহিলা কমিশনার’ মনোনীত করার বিষয়টি। দেশে যখন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ও স্থায়ী রূপদানের বিষয়টি সার্বজনীন দাবিতে পরিণত হয়েছে, সেখানে ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক সংরক্ষিত মহিলা কমিশনার পদে মনোনয়ন প্রদান করা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের রীতিনীতি ও চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী।

এছাড়াও, সংসদীয় মন্ত্রিপরিষদ পদ্ধতির বহুদলীয় সার্বজনীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মনোনয়ন দান প্রথাটি বেখাপ্পা, বেমানান। উপরন্তু, এটা একটা স্বৈরাচারী বিধি-ব্যবস্থাও বটে। পৌরসভাসহ যে কোন গণপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থায় শুধু মহিলা কেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীর প্রতিনিধিত্ব নানান কারণে প্রয়োজন। তাঁরা যে এসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে অনেক সহায়ক, মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে তাঁদের অবশ্যই এসব সংস্থার সার্বজনীন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত কমিশনারদের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে।

প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত কমিশনারবৃন্দ কর্তৃক যাঁরা এসব সংস্থায় বা প্রতিষ্ঠানে মহিলা বিষয়ে কিংবা বিভিন্ন বিশেষ বিষয়ে সহায়তা বা উপদেশ-পরামর্শ প্রদানের জন্যে নির্বাচিত হবেন তাঁদের পরামর্শক বা উপদেষ্টা কমিশনার’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে কিন্তু ভোটাধিকারী কমিশনার বা সদস্য হিসেবে নয়।

এখানে আরও একটি শর্ত আরোপ করা একান্ত প্রয়োজন। তা হচ্ছে এই যে, যেহেতু তাঁরা মহিলা বিষয়ে কিংবা বিভিন্ন বিশেষ বিষয়ে পরামর্শক-উপদেষ্টা কিংবা বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালনের জন্য নির্বাচিত হবেন, সেহেতু তাঁদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকাসহ কোন না কোন বিশেষ বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞানসম্পন্ন কিংবা বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে।

[ বাংলাদেশের সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী এবং আরও গণতান্ত্রিক করার প্রস্তাব – ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ]

২। ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার দেশের ৬৪টি জেলার জেলা পরিষদ’, উপজেলা (বর্তমান থানা) পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ’ ও গ্রাম পর্যায়ে ‘ইউনিয়ন পরিষদ’-এর ব্যাপারে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সে সম্পর্কে কিছু আলোকপাত ও পর্যালোচনা করা শুধু দেশের তথা জনগণের স্বার্থেই সমীচীন ও যুক্তিযুক্ত নয়, আবশ্যকীয়ও বটে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, উপরোল্লিখিত ‘পৌরসভা’, ‘জেলা পরিষদ’, ‘উপজেলা (বর্তমানে থানা) পরিষদ’ ও ‘ইউনিয়ন পরিষদ’-গুলো সার্বজনীন ভোটাধিকারভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গঠিত হওয়া উচিত।

এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ]
এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ]
জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হওয়া উচিত স্ব স্ব নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য পরিচর্যা, গণপূর্ত কর্মকাণ্ড, গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, মৎস্য, পশু, কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন, স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড, ক্রীড়া-খেলাধূলার আয়োজন অনুষ্ঠান ও উন্নয়ন, শিল্প-সংস্কৃতির উন্নয়ন, আমোদ-প্রমোদ ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, আইন-শৃংখলা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ইত্যাদির দেখাশুনা ও দায়িত্ব পালন করা।

বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলের শেষার্ধে গ্রাম পর্যায়ে ‘গ্রাম পঞ্চায়েত’, মহকুমা পর্যায়ে ‘তেহসিল’ ও জেলা পর্যায়ে জেলা বোর্ডে’র প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর প্রধান কাজ ছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থ রক্ষা, যথা : খাজনা-রাজস্ব, ট্যাক্স, বিভিন্ন লেভী, টোল, ইত্যাদি আদায় করা এবং স্ব স্ব এলাকায় আইন-শৃংখলা রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট আইন-শৃংখলা রক্ষাকারীদের সাহায্য-সহযোগিতা করা।

জনসেবা-সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড, সাংস্কৃতিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদির উন্নয়নে বৃটিশ শাসন আমলে সেসব প্রতিষ্ঠানের কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না বললেই চলে। সর্বোপরি, বৃটিশ আমলে সেসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বা সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতেন না। তাঁদের অনেকে ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা এবং অবশিষ্টরা হতেন সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসক কর্তৃক মনোনীত।

৩। পাকিস্তানী শাসন আমলে তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালে ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্র আদেশ (১৯৫৯)’-এর মাধ্যমে সীমিত গণতন্ত্রসহ গ্রাম পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ’, মহকুমা পর্যায়ে ‘তেহসিল কাউন্সিল’, জেলা পর্যায়ে ‘জেলা কাউন্সিল’ ও বিভাগীয় পর্যায়ে ‘বিভাগীয় কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ চার স্তরের ‘স্থানীয় সরকার’ ব্যবস্থায় একমাত্র ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা জনগণের সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত হতেন।

জেনারেল আইয়ুব খানের ‘বুনিয়াদী (বেসিক) গণতন্ত্রকে’ সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা হতো এই কারণে যে, জনগণের সার্বজনীন ভোটে নয়, কেবল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি, ‘কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট (পরিষদ বা সংসদ)’-এর সদস্যরা এবং প্রাদেশিক পর্যায়ে প্রদেশগুলোর ‘প্রাদেশিক এ্যাসেমরী (পরিষদ বা সংসদ)’-এর সদস্যরা নির্বাচিত হতেন।

Google News
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

তেহসিল কাউন্সিল’, ‘জেলা কাউন্সিল’ ও ‘বিভাগীয় কাউন্সিল’-এর প্রধানসহ অনেক সদস্য ছিলেন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অথবা প্রশাসক কর্তৃক মনোনীত সরকারী কর্মকর্তা এবং অবশিষ্টরা ছিলেন পরোক্ষভাবে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধি। সেসব কাউন্সিল (বা পরিষদ)-কে কিছু কিছু জনসেবা-সমাজসেবা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্বও অর্পণ করা হয়েছিল বটে, কিন্তু সেসবের অন্যান্য ভূমিকা ছিল বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলে সৃষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব ও ভূমিকার প্রায় অনুরূপ। উল্লেখ্য, সেসব প্রতিষ্ঠানের মেয়াদকাল ৫ বছর নির্ধারিত ছিল।

৪। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শাসন আমলে ১৯৭৩ সালের ‘রাষ্ট্রপতির ২২ নম্বর আদেশ’-এর মাধ্যমে দেশের ৬১টি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরের মাধ্যমে:

  • (১) গ্রাম পর্যায়ে জনগণের সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ৯ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ইউনিয়ন পরিষদ;
  • (২) থানা পর্যায়ে থানা পরিষদ’ এবং
  • (৩) জেলা পর্যায়ে জেলা পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা করা হয়।

সেসব পরিষদের মেয়াদকাল এবং ভূমিকা ও দায়িত্ব ছিল আইয়ুব খানের আমলে ১৯৫৯ সালে প্রবর্তিত বুনিয়াদী গণতন্ত্র অর্ডার (১৯৫৯)-এ উল্লিখিত ভূমিকা ও দায়িত্বের ঠিক অনুরূপ।

তাঁর শাসন আমলের শেষের দিকে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারীতে বাংলাদেশে জনগণের (প্রাপ্তবয়স্কের) সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রতি শাসন পদ্ধতি ও একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর, বঙ্গবন্ধু স্থানীয় সরকারগুলোকে স্ব স্ব নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য পরিচর্যা, গণপূর্ত কর্মকাণ্ড, গণস্বাস্থ্য, মৎস্য, পশু, কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন, স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড, ক্রীড়া-খেলাধুলার ব্যবস্থা আয়োজন-অনুষ্ঠান ও উন্নয়ন, শিল্প-সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশ, আমোদ-প্রমোদ ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, ইত্যাদির সংগঠনের ও দেখাশোনার দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করার কথা তাঁর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পূর্বে প্রদত্ত বিভিন্ন বক্তব্য, বক্তৃতা ও ভাষণে বলেছিলেন।M. A. Wazed Miah এম এ ওয়াজেদ মিয়া 1 বাংলাদেশের সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী এবং আরও গণতান্ত্রিক করার প্রস্তাব

এবং সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরুও করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকার কর্তৃক ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ২২ নম্বর আদেশ (১৯৭৩)’-এর মাধ্যমে সৃষ্ট ‘ইউনিয়ন পরিষদ’, ‘থানা পরিষদ’ ও ‘জেলা পরিষদ’-এর প্রধানকে সংশ্লিষ্ট পরিষদের (ভোটাধিকারী) সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে ক্ষমতা (বা পদ) থেকে অপসারণ করার বিধিবিধান ছিল। কিন্তু, কোন অবস্থাতেই সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অথবা সরকারী প্রশাসকের কার্যনির্বাহী আদেশবলে নয়।

৫। তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসন আমলের গোড়ার দিকে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ (১৯৭৬)’ জারির মাধ্যমে ‘ইউনিয়ন পরিষদ’, ‘থানা পরিষদ’ ও ‘জেলা পরিষদ’-এর মেয়াদকাল ৫ বছরে অপরিবর্তিত রেখে অন্যান্য অনেক বিধিবিধানের সংশোধন করা হয়। সেসব সংশোধন মোতাবেক ইউনিয়ন পরিষদ’-এর কাঠামো এবং দায়িত্ব ও ক্ষমতার বেশ কিছু পরবর্তন করা হয়।

প্রথমত, পূর্বতন ‘ইউনিয়ন পরিষদ’-এর ভাইস চেয়ারম্যানের পদ বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৭৬-এর স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশেও ইউনিয়ন পরিষদ’-এর চেয়ারম্যানদের পূর্বের মতোই প্রতিটি ইউনিয়ন-এ বসবাসরত জনগণের সার্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটে এবং ৯ জন সদস্যের ৯টি পৃথক ওয়ার্ডের জনগণের সার্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধিবিধান অপরিবর্তিত রাখা হয়। তবে, ১৯৭৬ সালের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে’ ‘ইউনিয়ন পরিষদের সরকার অথবা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসক কর্তৃক ২ জন মহিলা ও ২ জন কৃষক সদস্য মনোনীত করার ব্যবস্থা রাখা হয়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ইউনিয়ন পরিষদসহ যে কোন প্রতিষ্ঠানে মহিলা বিষয়ের জন্য মহিলাসহ আরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি প্রয়োজন ও বাঞ্ছনীয়। কিন্তু, এ জাতীয় মনোনীত ব্যক্তিদের সেসব প্রতিষ্ঠানের ভোটদানকারী সদস্যের পদমর্যাদা প্রদান করা কোনমতেই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়াও, এ জাতীয় মনোনীত মহিলাসহ অন্য বিশেষজ্ঞদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া একান্ত আবশ্যক।

এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোন জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানে বেসরকারী কোন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দানের প্রথা রাখা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, তা সম্পূর্ণভাবে গণতন্ত্রের রীতিনীতি পরিপন্থী। এ জাতীয় মহিলা ও অন্যান্য বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক মহিলা ও বিশেষজ্ঞের সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হওয়া উচিত।

এক্ষেত্রেও পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। পরিশেষে উল্লেখ্য যে, ১৯৭৬ সালের ‘স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে’ ‘ইউনিয়ন পরিষদে’র ওপর ৪০টি দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করা হয়। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রাজস্ব আদায়, গণপূর্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা, ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী’র মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং কিছু কিছু ছোটখাটো অপরাধ ও বিবাদ-বিসংবাদ সংক্রান্ত অভিযোগ বিচার সালিশীর মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা। ইউনিয়ন পরিষদে’র আয়ের উৎস ছিল, ১৯৫৯ সালের ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্র আদেশে’ উল্লেখিত ঠিক একই উৎস ও উপায়সমূহ।

৬। ১৯৭৬ সালের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে’ ‘থানা পরিষদ’, পদাধিকার বলে সাবডিভিশনাল অফিসারকে চেয়ারম্যান, সার্কেল অফিসারকে ভাইস চেয়ারম্যান এবং সংশিষ্ট থানার সকল ইউনিয়ন পরিষদে’র চেয়ারম্যানদের সদস্য করে গঠন করার বিধিবিধান রাখা হয়।

থানার ইউনিয়ন পরিষদগুলোর উন্নয়ন প্লানের ভিত্তিতে থানার উন্নয়ন প্লান প্রস্তুতকরণ, থানার ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান এবং (কেন্দ্রীয়) সরকার কর্তৃক অর্পিত বা প্রদত্ত কোন উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন করা থানা পরিষদ’-এর উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। এসব ছাড়াও, পরিবার পরিকল্পনা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও থানার ‘ইউনিয়ন পরিষদগুলো’র কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানও থানা পরিষদে’র দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পদাধিকার বলে ‘সাবডিভিশনাল অফিসার’ কর্তৃক ‘থানা পরিষদ-কে প্রদত্ত যাবতীয় কার্যনির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করার ব্যবস্থা ছিল ১৯৭৬ সালের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে। থানা পরিষদের সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত, এর সাধারণ সভায় অথবা এর বিভিন্ন কমিটির সভায় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণ করার বিধিবিধান ১৯৭৬ সালের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে রাখা হয়। উল্লেখ্য, ‘থানা পরিষদে’র কোন রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ছিল না। (কেন্দ্রীয়) সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুদানই ছিল এর ফান্ডের একমাত্র উৎস ।

৭। ১৯৭৬ সালের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে’ ‘জেলা পরিষদ’ জেলার নির্দিষ্ট সংখ্যক এলাকার জনগণের সাবর্জনীন প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ, সরকার কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দিষ্ট সংখ্যক মনোনীত মহিলা সদস্য এবং পদাধিকারবলে জেলার কতিপয় সরকারী কর্মকর্তা ও কতিপয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবর্গের সমন্বয়ে গঠন করার বিধিবিধান রাখা হয়।

উক্ত অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মোতাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানের জেলা পরিষদের নির্বাচিত ও মহিলা সদস্যবৃন্দ কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদে কখনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। তার পরিবর্তে জেলার ডেপুটি কমিশনার এবং অপর একজন সরকারী কর্মকর্তা (যথা : সহকারী গ্রাম উন্নয়ন পরিচালক অথবা সহকারী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পরিচালক) জেলা পরিষদের যথাক্রমে চেয়ারম্যান ও সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।

‘জেলা পরিষদে’র ওপর মোট ৯৭টি দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করা হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে কিছু ছিল বাধ্যতামূলক এবং অবশিষ্টাংশ ঐচ্ছিক। জেলা পরিষদকে জেলার সকল স্থানীয় পরিষদ, মিউনিসিপ্যাল সংস্থা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কর্মকাণ্ডের সমন্বয়কারীর দায়িত্বও পালন করার বিধিবিধান রাখা হয়েছিল ১৯৭৬ সালের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে’।

১৯৭৬ সালের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ’ মোতাবেক ‘জেলা পরিষদ’-এর উল্লেখযোগ্য প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল জেলার পাঠাগার, হাসপাতাল, ডিসপেনসারি, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, সেতু, বাগান, খেলার মাঠ, রেস্ট হাউস, ইত্যাদি নির্মাণ, সংরক্ষণ ও মেরামত করা। জেলা পরিষদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল (কেন্দ্রীয়) সরকারের অনুদান, বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স, লেভী, টোল, ইত্যাদি।

৮। জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে ‘স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ (১৯৭৬) -এর এক সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের প্রতিটি গ্রামে স্বনির্ভর গ্রাম। সরকার’ প্রবর্তন করা হয় । প্রতিটি গ্রামের ২ জন মহিলাসহ ১১ জন সদস্য ও একজন ‘সামপ্রধানের’ সমন্বয়ে ‘স্বনির্ভর গ্রাম সরকার’ গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। ‘স্বনির্ভর গ্রাম সরকারে’র ‘গ্রামপ্রধান ও সদস্যদের একটি সভায় গ্রামের উপস্থিত জনগণের সমঝোতা অথবা ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা ছিল।

‘স্বনির্ভর গ্রাম সরকারে’র সদস্যদের এমনভাবে নির্বাচন করার কথা ছিল যাতে গ্রামের বিভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম, সমর্থ ও যোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে এক সামরিক আইন আদেশ বলে ঐ স্বনির্ভর গ্রাম সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

৯। ১৯৮২ সালে দেশের জনগণের সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত সরকারকে সংবিধান লংঘনের মাধ্যমে বেআইনীভাবে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তার তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক ‘স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্বিন্যাস) অধ্যাদেশ (১৯৮২)’ জারির মাধ্যমে দেশের থানা পর্যায়ের প্রশাসনিক ইউনিটগুলোকে উপজেলা’ (Sub-District) নামকরণ করে উপজেলা পরিষদ’ গঠন এবং পূর্বতন থানা প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করেন।

ঐ অধ্যাদেশে পূর্বতন প্রতিটি থানা দফতরে অবস্থিত বিভিন্ন প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত দফতরগুলোর কর্মকাণ্ড একটিমাত্র প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে এনে সেসব সুসমন্বিতভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা ও বিধিবিধান রাখা হয়। তার ফলে, পূর্বতন থানার প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষা, শিক্ষা, পূর্ত কর্মকাণ্ড, রাস্তাঘাট নির্মাণ, কৃষি এবং মৎস্য ও পশু সম্পদের উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য পরিচর্যা, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ইত্যাদি কর্মকাণ্ড দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্ব ‘উপজেলা পরিষদ’ এবং ‘উপজেলা প্রশাসনের ওপর কিছু কিছু ভাগাভাগি আর অবশিষ্টাংশ সংযুক্তভাবে ন্যস্ত করা হয়।

একই সঙ্গে, ‘উপজেলা পরিষদে’র চেয়ারম্যানকে প্রশাসনিক ও অর্থ-সম্পর্কিত ব্যাপারে অত্যধিক ব্যাপক কার্যনির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করা হয় । উপরোল্লিখিত বিষয়াদি ছাড়াও, ১৯৮২ সালের ‘স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্বিন্যাস) অধ্যাদেশে’র বিভিন্ন বিধিবিধান বলে দেশের প্রতিটি পূর্বতন থানা দফতরে সর্বনিম্ন স্তরের বিচার প্রণালী হিসেবে বিচারালয় প্রতিষ্ঠারও ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, দেশের ‘থানা ইউনিট’গুলোর উপজেলা’ নামকরণে বিশেষ আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ, থানার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পুলিশ স্টেশন’।

তাছাড়া, ‘থানা’ নাম উচ্চারণে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের একরূপ ‘গন্ধ’ পাওয়া যায়, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের স্মৃতি মানসপটে জেগে ওঠে। উপরন্তু, ভবিষ্যতে প্রয়োজনবোধে প্রতিটি উপজেলায় একাধিক পুলিশ (থানা) অথবা পুলিশ স্থাপিত হতে তবে, উপজেলা পরিষদে’র ভোটাধিকারী মনোনয়নের বিষয়টি গণতন্ত্রের রীতিনীতি পরিপন্থী। সোজা ভাষায় অগণতান্ত্রিক।

কিন্তু সামরিক সরকারের পক্ষে এরূপ প্রতিষ্ঠা করাটাই স্বাভাবিক, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ তাছাড়া, উপজেলা পরিষদে’র মনোনীত সদস্যদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত বিশেষ বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান অভিজ্ঞতার কোনরূপ শর্ত রাখা বিশেষভাবে আপত্তিকর।

১৯৮২ সালের সরকার উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্বিন্যাস) অধ্যাদেশে’র মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা তার চেয়ারম্যানকে প্রশাসনিক অর্থ সম্পর্কিত বিষয়ে অত্যধিক ব্যাপক কার্যনির্বাহী প্রদানের পেছনে তৎকালীন মেজর জেনারেল হুসেইন এরশাদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি উপজেলা ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ও ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন সেসবের বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত ও কার্যকর করার যে সন্দেহ নেই।

১০। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সামরিক জান্তার নেতা সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ ‘স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন অধ্যাদেশ জারির দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন কিছু অতিরিক্ত প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৯৮৮ সালে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকার (জেলা পরিষদ) আইনে’র মাধ্যমে দেশের ৬৪টি জেলার পরিষদে’র পুনর্বিন্যাস সেসবের ওপর কিছু অতিরিক্ত প্রশাসনিক উন্নয়নমূলক দায়িত্ব অর্পণ করেন।

প্রসঙ্গে উল্লেখ্য পুনর্বিন্যস্ত ‘ইউনিয়ন পরিষদের ভোটাধিকারী সদস্যের এবং পরিষদের কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা সদস্যের মনোনয়ন দানের যে গণতন্ত্রের রীতিনীতি পরিপন্থী তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাছাড়াও, মনোনীত সদস্যদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা।

১১। ১৯৮৩ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশের বিধিবিধান অনুযায়ী ‘ইউনিয়ন পরিষদ সম্মিলিতভাবে ছিল সকল ক্ষমতার অধিকারী। প্রতিটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসক কর্তৃক মনোনীত ৩ জন মহিলা সদস্যসহ ১২ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত। হওয়ার ব্যবস্থা ছিল ১৯৮৩ সালের ‘স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশে”। ঐ অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসারে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের নির্দিষ্ট সারা এলাকায় বসবাসকারী ভোটারদের এবং ৯ জন সদস্যের সে ইউনিয়নের ৩টি পৃথক ওয়ার্ডে বসবাসকারী ভোটারদের সার্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে ৩ জন করে সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ১৯৮৩ সালের ‘স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ’ মোতাবেক ‘ইউনিয়ন পরিষদে’র মেয়াদকাল ছিল ৩ বছর।

১২। ১৯৮৩ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশে ইউনিয়ন পরিষদে’র ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহকে নিম্নোল্লিখিত ৫টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় ঃ

  • (১) পৌর (civic) সংক্রান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য;
  • (২) আইন-শৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত দায়িত্ব ও কর্তব্য;
  • (৩) রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা;
  • (৪) উন্নয়নমূলক দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং
  • (৫) (কেন্দ্রীয় সরকার ও উপজেলা পরিষদ’ কর্তৃক হস্তান্তরিত দায়িত্ব ও কর্তব্য।

যদিও ১৯৮৩ সালের ‘স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশে’ ৩৮টি পৌর সংক্রান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যের উল্লেখ রয়েছে, তবে সেখানে ‘ইউনিয়ন পরিষদ’কে নিম্নে বর্ণিত কাজগুলো সম্পাদন করতে বিশেষভাবে বলা হয় ঃ

(ক) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষণ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান;

(খ) বিশৃঙ্খলা ও চোরাচালান প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ;

(গ) জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্যে কৃষি, বৃক্ষ ও বন-সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, পশু সম্পদ, শিক্ষা, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য পরিচর্যা, কুটিরশিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা, জলসেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদির উন্নয়নে ‘উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন;

(ঘ) পরিবার পরিকল্পনার উন্নতি;

(ঙ) উপজেলা কর্তৃক যেসব উন্নয়ন প্রকল্প হস্তান্তর করা হবে, সেসবের বাস্তবায়ন;

(চ) স্থানীয় সম্পদ-উপায়াদির যোজন ও তার ব্যবহার;

(ছ) সরকারী সম্পত্তি যেমন রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট, খাল, বাঁধ, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইনসমূহের সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ;

(জ) ইউনিয়ন পর্যায়ে সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পরিদর্শন-পুনঃরীক্ষণ এবং সেসব সম্পর্কে ‘উপজেলা পরিষদ’কে মতামত-সুপারিশ প্রদান;

(ঝ) স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা-শৌচাগার স্থাপনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও প্ররোচিতকরণ;

(ঞ) মানুষের জন্ম, মৃত্যু, ভিক্ষুক ও নিঃস্বদের নিবন্ধিকরণ;

(ট) সর্বপ্রকার লোক-গণনা, আদমশুমারি পরিচালনা, ইত্যাদি।

১৯৮৩ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশে’ উল্লেখিত দায়িত্ব ও কর্তব্যসহ সময়ে সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও এজেন্সী কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে ‘ইউনিয়ন পরিষদ’কে আরও অনেক অতিরিক্ত কার্য সম্পাদন ও দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিভিন্ন সনদপ জারিকরণ, ব্যাপারী বা পরিবেশক নির্বাচন, ত্রাণকার্য সম্পাদন, ধার-দেনা-ঋণের ইত্যাদি ব্যাপারে ছাড়পত্র প্রদান, চিকিৎসার ব্যাপারে সুপারিশ প্রদান, সালিশী আদালতে না পাঠিয়ে বিভিন্ন ছোটখাটো ঝগড়াবিবাদ সম্পর্কিত বিষয়ের নিষ্পত্তিকরণ, অতিরিক্ত কার্যাদির দায়িত্বও ইউনিয়ন পরিষদ কে পালন করতে হয়।

১৩। ১৯৮২ সালের স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্বিন্যাস) অধ্যাদেশে’র সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মোতাবেক ‘উপজেলা পরিষদ’:

(১) একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান

(২) প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে উপজেলার এখতিয়ারভুক্ত সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানবৃন্দ

(৩) উপজেলায় বসবাসরতদের মধ্য হতে সরকার কর্তৃক মনোনীত ৩ জন মহিলা সদস্য

(৪) উপজেলায় অবস্থিত বিভিন্ন অফিসে কর্মরত অফিসারদের মধ্য হতে সরকার কর্তৃক বিনির্দিষ্ট ভোটদান ক্ষমতার অধিকারবিহীন পদ হেতু সদস্য

(৫) উপজেলার কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান এবং

(৬) উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্য ও উপযুক্ত পুরুষ ব্যক্তিদের মধ্য হতে সরকার কর্তৃক একজন মনোনীত পুরুষ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হয়। উপজেলা পরিষদের সকল প্রতিনিধি সদস্য এবং সরকার কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসক কর্তৃক মনোনীত ৫ জন সদস্য উপজেলা পরিষদে’র (সাধারণ) সভায় ভোটাধিকার প্রয়োগ অর্থাৎ ভোট প্রদান করতে পারেন।

১৯৮২ সালের স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্বিন্যাস) অধ্যাদেশে’র সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মোতাবেক উপজেলার চেয়ারম্যান’, উপজেলার এখতিয়ারভুক্ত ও বিনির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের সার্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত (কেন্দ্রীয়) সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ও পদস্থ উপজেলা প্রশাসনের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা’, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার’ (UNO), উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালের স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্বিন্যাস) অধ্যাদেশ’ অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের মেয়াদকাল ছিল ৫ বছর।

১৪। ১৯৮২ সালের স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্বিন্যাস) অধ্যাদেশে’ উল্লিখিত ‘প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের নীতি’ অনুসারে দেশের প্রতিটি ‘উপজেলা’ (পূর্বের থানা) একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র বা ইউনিটে পরিণত হয়। ঐ নতুন ব্যবস্থায় দেশের প্রতিটি উপজেলা পরিষদ’ একটি ‘সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে পরিগণিত হয়।

এক অর্থে, ‘উপজেলা সদর’ প্রশাসনের অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র (Pivot) হিসেবে পূর্বতন জেলা প্রশাসনের প্রতিস্থাপকে পরিণত হয় ১৯৮২ সালের স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্বিন্যাস) অধ্যাদেশে’র মাধ্যমে। পূর্বে জেলা সদর যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতো, ঐ নতুন ব্যবস্থায় তার অনেক দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা ‘উপজেলা পরিষদ’ এবং উপজেলা প্রশাসনের ওপর অর্পিত হয়।

১৫। ‘উপজেলা পরিষদ’ ও ‘উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থায় তার দায়িত্ব ও কর্তব্য দু’শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় : (কেন্দ্রীয়) সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত বিষয়াদি’ এবং (কেন্দ্রীয়) সরকার কর্তৃক ‘হস্তান্তরিত বিষয়াদি’। ‘উপজেলা পরিষদ’ ও ‘উপজেলা প্রশাসন’ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ‘সংরক্ষিত বিষয়াদির’ মধ্যে নিম্নোল্লিখিত দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :

(১) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা;

(২) দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা;

(৩) কেন্দ্রীয় রাজস্ব, যেমন আয়কর, শুল্ক, অন্তঃশুল্ক (আবগারী), ভূমি উন্নয়ন কর, বিক্রয় কর, ইত্যাদির প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা;

(৪) অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ-রক্ষণ;

(৫) ভারী শিল্প স্থাপন;

(৬) একাধিক জেলার জলসেচ ব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা;

(৭) খনিজ সম্পদের উন্নয়ন ও আহরণ;

(৮) বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ;

(৯) প্রাথমিক শিক্ষার ওপরে কারিগরি ও অন্যান্য শিক্ষার ব্যবস্থাপনা;

(১০) আধুনিক হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা;

(১১) আন্তঃজেলা ও আন্তঃউপজেলা যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা;

(১২) বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিসম্পদ উন্নয়ন এবং (১৩) জাতীয় যাবতীয় পরিসংখ্যান সংকলন ইত্যাদি।

১৬। (কেন্দ্রীয়) সরকার কর্তৃক উপজেলা পরিষদ’ এবং ‘উপজেলা প্রশাসন’-এর ওপর ‘হস্তান্তরিত বিষয়াদির’ মধ্যে নিম্নোল্লিখিত দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঃ

(১) সম্প্রসারণ সেবা, প্রসম্ভার (Input) সেবা ও জলসেচসহ কৃষি সম্পর্কিত কর্মসূচী;

(২) প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা;

(৩) উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসমূহ, প্রসূতি-শিশু হাসতপাল (MCH) ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সেবাসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী;

(৪) গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্য-বিধান কর্মসূচী;

(৫) গ্রামীণ পূর্ত কর্মসূচী;

(৬) কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী;

(৭) ভালনারাবল গ্রুপ ফিডিং (VGF), ইনস্টিটিউশনাল গ্রুপ ফিডিং ইত্যাদিসহ সমূহ দুর্ঘটনায় ত্রাণকার্য,

(৮) সমবায় ও সমবায়ভিত্তিক গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচী এবং

(৯) মৎস্য ও পশু সম্পদের উন্নয়ন ইত্যাদি।

১৭। ১৯৮২ সালের ‘স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্বিন্যাস) অধ্যাদেশে’র মাধ্যমে (কেন্দ্রীয়) সরকার কর্তৃক উপজেলা পরিষদ’ এবং ‘উপজেলা প্রশাসনে’র ওপর ‘হস্তান্তরিত’ উপরোল্লিখিত বিষয়াদির তালিকা থেকে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, “উপজেলা পরিষদে’র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য হয় তার এখতিয়ারভুক্ত ও বিনির্দিষ্ট এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ প্রণয়ন, সেসবের উন্নতি বাস্তবায়ন করা।

এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ] তার পরিবারের সাথে।
এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ] তার পরিবারের সাথে।
স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নতি, শিল্প ও কৃষির সমৃদ্ধি এবং স্থানীয় কর্ম সংস্থান ও চাকুরির ব্যবস্থা করার দায়িত্বও অর্পিত হয় ‘উপজেলা পরিষদ’ এবং উপজেলা প্রশাসনের’ ওপর। ‘বার্ষিক উপজেলা উন্নয়ন প্লানে’র অর্থসংস্থানে (কেন্দ্রীয়) সরকার প্রতিবছর ‘খোক (অর্থ)’ বরাদ্দ করে।

(কেন্দ্রীয় সরকারের যথাক্রমে ‘পরিকল্পনা কমিশন’ ও ‘স্থানীয় সরকার বিভাগ’ ‘উপজেলা’র উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ প্রণয়নে এবং সেসব বাস্তবায়নে উপজেলা কর্তৃপক্ষসমূহকে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা ও কার্যকরী নির্দেশ প্রদান করে। উন্নয়নমূলক কার্যাদির দ্রুত বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা বিধানে ‘বার্ষিক উপজেলা উন্নয়ন প্লান’ (AUDP) অনুমোদনের সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত ক্ষমতা উপজেলা পরিষদে’র ওপর ন্যস্ত করা হয়।

ইতিপূর্বে, পূর্বতন ‘থানা পরিষদ প্লান’ পরীক্ষা ও অনুমোদনের ক্ষমতা ছিল ‘জেলা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষে’র ওপর ন্যস্ত। এ সমস্ত উন্নয়নমূলক ‘হস্তান্তরিত বিষয়ের ব্যাপার ছাড়াও, (কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত বিষয়াদির ব্যাপারে জড়িত উপজেলা সদরে পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের উপজেলা পরিষদের নিকট জবাবদিহি করা হয়।

সর্বোপরি, উপজেলা পরিষদকে সেসব কর্মকর্তার কাছ থেকে তাদের স্ব স্ব কর্মকাণ্ডের ওপর প্রতিবেদন, তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও অফিস পরিদর্শন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যে কোন গাফিলতি ও অবহেলা সম্পর্কে (কেন্দ্রীয়) সরকারের নিকট রিপোর্ট করার অধিকার ও ক্ষমতা দেওয়া হয়।

১৮। ১৯৮৮ সালের ‘স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনে’ ‘জেলা পরিষদ (১) জেলার নির্বাচিত সংসদ সদস্যবৃন্দ, (২) জেলার উপজেলা পরিষদ’ ও পৌরসভাসমূহের চেয়ারম্যানবৃন্দ, (৩) নির্দিষ্ট সংখ্যক মনোনীত পুরুষ সদস্য, (8) নির্দিষ্ট সংখ্যক মনোনীত মহিলা সদস্য এবং (৫) জেলার ডেপুটি কমিশনারসহ জেলা পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠনের ব্যবস্থা করা হয়।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে সরকার কর্তৃক নিয়োগ দানের বিধিবিধান রাখা হয়। জেলা পরিষদে’র কার্যকাল ছিল ৩ বছর। ১৯৮৮ সালের স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনে’ ‘জেলা পরিষদে’র ওপর ১২টি ‘বাধ্যতামূলক’ এবং ৬৯টি ‘ঐচ্ছিক’ দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করা হয়।

জেলা পরিষদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল তার এখতিয়ার ও আওতাভুক্ত এলাকার উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক প্রকল্পসমূহ প্রণয়ন, সেসবের অগ্রগতি সাধন ও বাস্তবায়ন করা। জেলা পরিষদের ‘বাধ্যতামূলক বিষয়াদি’র মধ্যে নিম্নোল্লিখিত বিষয়গুলো ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :

(১) জেলার উন্নয়ন তৎপরতার ও কর্মকাণ্ডের সমীক্ষা করা

(২) উপজেলা পরিষদ’গুলোর উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের মূল্যায়ন করা এবং উপজেলা পরিষদ’সমূহের ও জেলা পরিষদে’র হিসাব নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা;

(৩) পাবলিক লাইব্রেরী স্থাপন ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করা;

(৪) (কেন্দ্রীয়) সরকারের কিংবা উপজেলা পরিষদের কিংবা পৌরসভার এখতিয়ার-আওতাভুক্ত অথবা সেসবের জন্য সংরক্ষিত নয় এমন সব রাস্তাঘাট, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, সেসবের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নতি সাধন করা;

(৫) জনসাধারণের ব্যবহার্যে বৃক্ষরোপণ ও রাস্তার পাশের বৃক্ষরাজির সংরক্ষণ করা ;

(৬) জনসাধারণের ব্যবহার্যে উদ্যান, খেলাধুলার মাঠ ও খোলা জায়গার উন্নতি ও রক্ষণাবেক্ষণ করা;

(৭) (কেন্দ্রীয় সরকার, উপজেলা অথবা পৌরসভা কর্তৃক রক্ষিত নয় এমন সব ‘ফেরিঘাটের’ ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ করা;

(৮) ‘ডাকবাংলা’ ও বিশ্রামাগার স্থাপন ও সেসবের রক্ষণাবেক্ষণ করা;

(৯) উপজেলা পরিষদকে সাহায্য-সহযোগিতা এবং সর্বপ্রকার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদান করা এবং

(১০) (কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অর্পিত যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প কার্যকর করা। জেলা পরিষদের ঐচ্ছিক বিষয়াদির মধ্যে নিম্নোল্লিখিত দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ ছিল উল্লেখযোগ্য : জেলার এখতিয়ার ও আওতাভূক্ত এলাকার শিক্ষা সংস্কৃতি, সামাজিক উন্নয়ন, স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য, গণপূর্ত কর্মকাণ্ড এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নতি বিধান করা। অধিকন্তু, জেলা পরিষদ গবাদি পশু, হাস-মুরগী পালন, কুটির শিল্প, হাট-বাজার প্রতিষ্ঠা, ইত্যাদির ব্যাপারে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে।

১৯। উপরোল্লিখিত তথ্যাদি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, স্ব স্ব এখতিয়ার ও আওতাভুক্ত এলাকার ভৌত অবকাঠামো এবং পরিবেশসহ আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে ‘পৌরসভা’, ‘জেলা পরিষদ’, ‘উপজেলা পরিষদ’ ও ‘ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রকল্প প্রণয়ন প্রক্রিয়ার ও প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণে এসব ‘স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা’ যে অপরিহার্য তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

‘জেলা পরিষদে’র সার্বিক দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং ‘পৌরসভা’র সীমিত এলাকার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বাইরে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ) জনগণের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ’ এবং ‘উপজেলা (বা থানা) পরিষদ’ ব্যবস্থা অপরিহার্য। বিশেষ করে, “উপজেলা (বা থানা) পরিষদ’ দেশের বিপুল (সংখ্যাগরিষ্ঠ) জনগণের সাংস্কৃতিক, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র (Pivot) হিসেবে মূল্যবান সুদূরপ্রসারী ভূমিকা, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে একান্ত প্রয়োজন ও অপরিহার্য।

কিন্তু, অতীব পরিতাপ ও দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, জনগণের সার্বজনীন ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার (বিএনপি) সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পর স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ (১৯৯১)’ এবং স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ (১৯৯২)’ জারির মাধ্যমে (অর্থাৎ কলমের এক খোঁচায়) যথাক্রমে পূর্বতন ইউনিয়ন পরিষদ” ও পূর্বতন উপজেলা পরিষদ’ বিলুপ্ত করে।

‘স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ (১৯৯১)’ জারির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার পূর্বতন ‘ইউনিয়ন পরিষদে’র পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করে। পক্ষান্তরে, ‘স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ (১৯৯২)’ জারির মাধ্যমে পূর্বতন ‘উপজেলা পরিষদ’ স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করা হয় এবং পূর্বতন উপজেলা প্রশাসনিক এলাকার নামকরণ করা হয় ‘থানা’ হিসেবে।

এই শেষোক্ত কাজটি অত্যন্ত হাস্যকর, যার কারণ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত (কোমলভাবে অভিহিত উন্নয়নশীল) দেশের অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাকর বিষয় এই যে, দেশের নেতা-নেত্রীগণ গণতন্ত্রের বড় বড় বুলি আওড়ান, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ও স্থায়ী রূপদানের প্রয়াসে জীবন উৎসর্গ করবেন বলে চিৎকার করে বুক ফাটান, কিন্তু কার্যত করেন তার উল্টোটা।

এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ] স্ত্রী শেখ হাসিনা কে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।
এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ] স্ত্রী শেখ হাসিনা কে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।
অর্থাৎ অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড  বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার কর্তৃক ‘ইউনিয়ন পরিষদ’ এবং উপজেলা পরিষদ বিলুপ্তি ঘোষণা সংক্রান্ত কার্যাদি নিঃসন্দেহে অগণতান্ত্রিক। সোজা কথায় স্বৈরতান্ত্রিক। দেশের আপামর জনগণের দৃঢ়বিশ্বাস যে, প্রশাসন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দেশের অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার স্বার্থেই উপজেলা পরিষদ’ ও ‘উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থা একদিন না একদিন দেশে সুদৃঢ়ভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। বোধ হয় সেদিন আর বেশী দূরে নয়।

২০। জনগণের সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার শুধু ‘ইউনিয়ন পরিষদ’ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস এবং ‘উপজেলা পরিষদ’ ও ‘উপজেলা প্রশাসন’ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) অধ্যাদেশ (১৯৯১)’ জারির মাধ্যমে বেআইনী ও স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় ‘পৌরসভাগুলোও’ বিলুপ্ত করে সেসবের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাদের ওপর ন্যস্ত করে।

তাছাড়াও, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার এক ‘স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ (১৯৯৩)’ জারির মাধ্যমে এবং বেআইনী ও স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় ‘জেলা পরিষদ’ বিলুপ্ত করে সেসবের পরিচালনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ন্যস্ত করে।

যাহোক, ১৯৯২ সালের ২৭শে জানুয়ারী তারিখ থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সময়কালে দেশের পুনর্বিন্যস্ত ‘ইউনিয়ন পরিষদে’র এবং ১৯৯৩ সালের ২৭শে জানুয়ারী তারিখে ‘পৌরসভাগুলো’র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

খামখেয়ালী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দেশের ‘পৌরসভা’ ও ‘ইউনিয়ন পরিষদ’-এর বিলুপ্তি, পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন এবং উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থার স্থায়ীভাবে বিলুপ্তিকরণ এবং পরবর্তীতে তাকে মনোনীত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত ‘থানা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি’ দ্বারা প্রতিস্থাপন ইত্যাদি পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রায়ন ও প্রতিষ্ঠানিক রূপদান সম্পন্ন করা হয়েছে কি?

আসলে হয়নি। এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে, যথা : ‘পৌরসভা’য় ও ইউনিয়ন পরিষদের পূর্বের মতো নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য এবং থানা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সকল সদস্যকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত করার বিধিবিধান ও ব্যবস্থা কোনমতেই গণতন্ত্রের রীতিনীতিসম্মত নয়। এসব ব্যবস্থার প্রবর্তন নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং স্বৈরতান্ত্রিক মন-মানসিকতা ও আচার-আচরণের প্রতিফলন। উপরন্তু, স্বৈরতান্ত্রিকভাবে এসবের বিলুপ্তি এবং পরবর্তীতে এসবের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় অর্থ, সম্পদাদি ও জনবলের অনর্থক-অযথা সময়-শক্তির অপব্যয় ও অপব্যবহার করা হয়।

২১। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ইতিপূর্বে জারিকৃত ‘স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ (১৯৯৩)’-টিকে একটি বিল হিসেবে ৪ঠা জুলাই (১৯৯৩) তারিখে জাতীয় সংসদে আলোচনা ও অনুমোদনের জন্যে সংসদে উপস্থাপন করে। কিন্তু সংসদে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্য বিরোধী দলগুলোর ঐ বিলের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক বিধিবিধানের তীব্র বিরোধিতা এবং সরকারী দলের সাংসদদের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধের কারণে তা সংসদের বিশেষ কমিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়।

সেই (জেলা পরিষদ) বিলটি এখনও সংসদের বিশেষ কমিটির ডীপ ফ্রীজে হিমায়িত অবস্থায় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার কর্তৃক বহু পূর্বে গঠিত ‘স্থানীয় সরকার কাঠামো পর্যালোচনা কমিশনে’র সে ব্যাপারে পেশকৃত মতামত-সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদনের আলোকে ঐ জেলা পরিষদ বিল (১৯৯৩) প্রণীত হয়। উক্ত কমিশনের প্রতিবেদনে ‘জেলা পরিষদে’র ক্ষেত্রে বলা হয় ঃ “জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হবেন নির্বাচিত।

জেলার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি থানার সকল ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ কর্তৃক নির্বাচিত দু’জন প্রতিনিধি সদস্য এবং জেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও সদস্যবর্গ কর্তৃক নির্বাচিত ৩ জন মহিলা সদস্যার সমন্বয়ে ‘জেলা পরিষদ গঠিত হবে।M. A. Wazed Miah এম এ ওয়াজেদ মিয়া 2 বাংলাদেশের সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী এবং আরও গণতান্ত্রিক করার প্রস্তাব

তবে শর্ত এই যে, কোন একটি থানা থেকে একাধিক মহিল৷ সদস্য নির্বাচিত হবেন না। ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন জেলার অন্তর্ভুক্ত ‘গ্রাম সভা’গুলোর সদস্য-সদস্যা এবং ইউনিয়ন পরিষদসমূহের সকল চেয়ারম্যান ও সদস্য-সদস্যার সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্যাপকভিত্তিক নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে।”

জেলা পরিষদ সদস্যদের নির্বাচনের এই পদ্ধতি যে মনোনয়ন দানের প্রথার তুলনায় অধিকতর গণতান্ত্রিক তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে, ‘জেলা পরিষদের সদস্য পদের নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু প্রার্থীদের জন্য আবশ্যিকভাবে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত আরোপ করা প্রয়োজন।

একই সঙ্গে, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু প্রার্থীদের জন্যও ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত আরোপ করা একান্ত আবশ্যক। অনুরূপভাবে, ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত আরোপ করে থানার প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে উপজেলা বা থানা পরিষদে’র জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের একজন সদস্য/সদস্যা নির্বাচিত করা যেতে পারে।

একই সঙ্গে, উপজেলা বা থানা পরিষদে’র চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু প্রার্থীদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত আরোপ করা একান্ত আবশ্যক। উপজেলা বা থানা পরিষদে’র চেয়ারম্যান উপজেলা বা থানার অন্তর্গত সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের এবং উপজেলা বা থানা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত করা যেতে পারে।

জেলা পরিষদের বেলায় ‘স্থানীয় সরকার কাঠামো পর্যালোচনা কমিটি’ আরও সুপারিশ করে ঃ “জেলার অন্তর্গত ‘পৌরসভাসমূহের’ চেয়ারম্যানগণ এবং জেলা পরিষদের প্রয়োজনানুসারে জেলার কর্মকর্তাদের মধ্য হতে সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট কর্মকর্তাগণ জেলা পরিষদের সভায় পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট জেলার সকল সংসদ সদস্য-সদস্যা ‘জেলা পরিষদে’র ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। জেলা পরিষদের কার্যকাল হবে ৫ বছর।”

২২। উপরোল্লিখিত তথ্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক। প্রথমত, পূর্বে উল্লিখিত অপরিহার্যতার কারণে ‘ইউনিয়ন পরিষদ’, ‘উপজেলা বা থানা পরিষদ’, ‘জেলা পরিষদ’, ‘পৌরসভা’, ‘সিটি কর্পোরেশন’, ইত্যাদি স্থানীয় সরকারসমূহের চেয়ারম্যানদের নির্বাচন ব্যবস্থাও বর্তমান সংসদীয় মন্ত্রিপরিষদ পদ্ধতির সরকারপ্রধান নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত।

এটা যে সম্ভব, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই এবং তা বাস্তবায়ন করা একান্ত দরকার। বর্তমানে যেখানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংসদীয় মন্ত্রিপরিষদ পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে স্থানীয় সরকার’ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির নির্বাচন-কাঠামো রাখা কোনমতেই সমীচীন ও যুক্তিযুক্ত নয়।

সুতরাং, প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের, উপজেলা বা থানা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা বা থানা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের, জেলা পরিষদে’র চেয়ারম্যান ‘জেলা পরিষদে’র নির্বাচিত সদস্যদের, ‘পৌরসভা’র চেয়ারম্যান ‘পৌরসভা’র নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনারদের এবং “সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ‘সিটি কর্পোরেশনে’র নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনারদের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধিবিধানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে, যে কোন পরিষদ ও পৌরসভার চেয়ারম্যানের এবং যে কোন সিটি মেয়রের পদ যে কোন কারণে শূন্য হলে তা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ও সময়-শক্তি ব্যয়ে নতুন করে নির্বাচিত করার প্রয়োজন না। সংশ্লিষ্ট পরিষদ কিংবা সভা কর্পোরেশনের নির্বাচিত নিজেদের মধ্য থেকে স্বল্প সময় ও ব্যয়ে তার নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতে পারবেন। তারপর, পরবর্তীকালে কেবল সংশ্লিষ্ট সদস্য কিংবা ওয়ার্ড কমিশনারের পদে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে, যা অতি অল্প সময়ে, অল্প ব্যয়ে ও অতি সহজেই সম্ভব।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এসব প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা, সুস্থ গণতন্ত্র ও স্বার্থে এই শর্ত করা যেতে পারে যে, এসব ‘স্থানীয় সরকার প্রধানদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত ভোটাধিকারী সদস্যদের কেবল ‘দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে অপসারণ করা যাবে, কোন অবস্থাতেই সরকারের কার্যনির্বাহী।

২৩। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে, যে কোনও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের কোন রকম করার ব্যবস্থা রাখা গণতন্ত্রের রীতিনীতি পরিপন্থী। সুতরাং, মহিলাসহ বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি, উপদেষ্টা বা হিসেবে, কিন্তু সদস্য হিসেবে নয়, ইউনিয়ন পরিষদে’ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত উপজেলা বা থানা পরিষদে’ চেয়ারম্যানসহ নির্বাচিত সদস্যদের, ‘জেলা পরিষদে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ নির্বাচিত সদস্যদের, ‘পৌরসভা’য় পৌরসভার চেয়ারম্যানসহ ওয়ার্ড কমিশনারদের এবং কর্পোরেশনে’ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ ওয়ার্ড কমিশনারদের ভোটে পরোক্ষ নির্বাচিত করা অধিকতর গণতন্ত্রসম্মত হবে।

যে কোন গণপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য এরূপভাবে সমন্বয়ে সে প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা বা কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। তবে, এরূপ ক্ষেত্রে এই শর্ত আরোপ করতে হবে যে, উপদেষ্টা পদের নির্বাচনে মহিলাসহ যাঁরা প্রার্থী তাঁদের আবশ্যিকভাবে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষ ন্যূনতম জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতে শেষ ও তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, জাতীয় সংসদ বা থানা পরিষদ’ এবং ‘জেলা পরিষদে’র কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা।

এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ]
এম এ ওয়াজেদ মিয়া [ M. A. Wazed Miah ]
এটা করা প্রয়োজন এই যে, জাতীয় সংসদে ভূমিকা পালন ছাড়াও জনগণ তাঁদের সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে আরও অনেক কিছু প্রত্যাশা করেন। এটা করা পরিষদে’র প্রস্তাবিত উপদেষ্টা কমিটিতে জেলার সাংসদগণ কখনো উপদেষ্টা হিসেবে, আবার কখনো জাতীয় সংসদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে ঐ উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

একই নীতি ও পদ্ধতি উপজেলা বা থানা পরিষদের উপদেষ্টা কমিটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ‘জেলা পরিষদে’র চেয়ারম্যান এবং উপজেলা থানা পরিষদের চেয়ারম্যান স্ব স্ব পদাধিকার বলে যথাক্রমে প্রস্তাবিত ‘জেলা পরিষদ উপদেষ্টা কমিটি’ এবং উপজেলা বা থানা পরিষদ উপদেষ্টা কমিটি’র ভাইস-চেয়ারম্যান হবেন।

২৪। পরিশেষে বলা যায় যে, ঠিক এই প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ॥ও স্থায়ী রূপদান করা যায়। এই প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার পর্যায়’ অর্থাৎ দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো দলগতভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।

যদি ‘স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনগুলোয় রাজনৈতিক দলগুলোর দলগতভাবে অংশগ্রহণের ব্যবস্থাও প্রবর্তন করা হয়, তাহলে প্রস্তাবিত ইউনিয়ন পরিষদ উপদেষ্টা কমিটি, উপজেলা বা থানা পরিষদ উপদেষ্টা কমিটি’, *জেলা পরিষদ উপদেষ্টা কমিটি’, ‘পৌরসভা উপদেষ্টা কমিটি’ এবং ‘সিটি কর্পোরেশন উপদেষ্টা কমিটি’র উপদেষ্টা বা পরামর্শক সদস্যদের দলগুলোর সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা অথবা তার আওতা ও এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় মোট প্রাপ্ত সাধারণ ভোটের অনুপাতের ভিত্তিতে নির্বাচিত করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত হবে।

প্রস্তাবিত ব্যবস্থা যে গণতন্ত্রকে সুসংহতকরণ, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ও স্থায়ী রূপদান এবং দেশের জনগণের সার্বিক উন্নয়ন-উন্নতি ও কল্যাণের স্বার্থে একান্ত প্রয়োজন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

#এই প্রবন্ধটি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (বাংলাদেশ) কর্তৃক ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত লেখকের বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শিরোনামের গ্রন্থটি থেকে উদ্ধৃত।

আরও পড়ুন:

 

Leave a Comment