আশ্রয়ণ প্রকল্পঃ একেকটি গৃহ প্রান্তিক মানুষের সামাজিক মর্যাদার প্রতিক হয়ে উঠেছে

একটি আশ্রয় কেবল নয়, প্রান্তিক মানুষকে নতুন উদ্যমে বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। একটি গৃহ তাদের কাছে কেবল আবাস নয়। সামাজিক মর্যাদারও প্রতিক।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দশ উদ্যোগের অগ্রাধিকার কর্মসূচি আশ্রয়ণ প্রকল্পের সহায়তায় চট্টগ্রাম জেলার হাজার হাজার প্রান্তিক মানুষ নতুন জীবন পেয়েছেন। ফিরে পেয়েছেন আত্মবিশ্বাস।  সরেজমিনে সাতকানিয়ার আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকা ঘুরে পাওয়া গেছে এমন চিত্র। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যেসব মহিলা ঘর পেয়েছেন তাদের কারো বিয়ের পরও থাকতে হয়েছে বাপের ভিটায়। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তারা ঠাঁই পেয়েছেন  দয়ার দানে অন্যের জমিতে ঝুপড়ি ঘরে। কেউ আবার খাজনা না দিতে  পেরে হারিয়েছেন নিজের বসত ভিটাটিও। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ও জমি পেয়ে আজ তাদের ভাসমান জীবনের অবসান হয়েছে।

 

আশ্রয়ণ প্রকল্পঃ একেকটি গৃহ প্রান্তিক মানুষের সামাজিক মর্যাদার প্রতিক হয়ে উঠেছে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

জেলার সাতকানিয়া-উপজেলার ছদাহা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম জানান, স্বামীর ভিটে না থাকায় আগে থাকতেন বাপের বাড়িতে। স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন ঝুপড়ি ঘরে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়ে তিনি একটি মুদি দোকান করেছেন। সেখানে গয়না, শাড়ি, চুড়ি, লুঙ্গি, গামছা, পান, চিপস ও শিশুদের খেলনাসহ নানা রকমের জিনিস বিক্রি করে ভালোই আয় করেন। তিনি বলেন, বাপের বাড়িতে যে ঝুপড়ি ঘর ছিল, সেখানে বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি পড়তো। ভিজে যেত বিছানা ও জিনিসপত্র। বছরের পর বছর অনেক রাত না ঘুমিয়েই কাটিয়েছেন। ঝড় শুরু হলে মনে হতো কখন যে ঘরটি বাতাসের তোড়ে উড়ে যাবে।

তিনি বলেন, এখন শান্তিতে ঘুমাই। দিনমজুরি করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা রোজগার করেন স্বামী। আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করছি, মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা যেন দীর্ঘজীবী হন। একই  প্রকল্পের বাসিন্দা নুর বানু বেগম। পরিচয় দিতেই ঘরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানালেন। বসার জন্য মোড়া দিলেন। ঘরে চলছে রঙিন এলইডি টেলিভিশন। টিভিতে সিনেমা দেখছেন মেয়ে খুরশিদা বেগম ও নাতনি নাঈমা সুলতানা । নুর বানু বলেন, বিয়ের কয়েক বছর পর মারা যান স্বামী।

অনেক কষ্টে সন্তানদের নিয়ে স্বামীর ভিটায় ঝুপড়ি ঘরে ছিলাম। খেয়ে না খেয়ে কাটিয়েছি বছরের পর বছর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে নিজের নামে ঘর ও জমি দিয়েছেন। বসতির চিন্তা না থাকায় আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। কাছের পাহাড় থেকে লাকড়ি কুড়াই ও অন্যের জমিতে কাজ করি। এছাড়া সেলাই মেশিনে কাজ করেও আয় হয়। এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি।

 

আশ্রয়ণ প্রকল্পঃ একেকটি গৃহ প্রান্তিক মানুষের সামাজিক মর্যাদার প্রতিক হয়ে উঠেছে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সাতকানিয়া-উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, সাতকানিয়ায় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর অধীনে ছদাহার সাঁড়াশিয়া ও মাদার্শা মৌজায় ৪০ টি গৃহহীন পরিবারকে ঘর বরাদ্দ  দেয়া হয়। বর্তমানে সব ঘরের মালিকরা ঘর ও জমির কাগজপত্র বুঝে পেয়েছেন। তৃতীয় পর্যায়ে আরো ৪৮ টি ঘর তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।

একই আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়েছেন সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের গারাংগিয়া এলাকার জাফর আলম ও বদিউল আলম। তারা দুইজনই আপন ভাই। একজন ট্যাক্সি চালান, অন্যজন চায়ের দোকানে চাকুরি করেন। জাফর আলম বলেন, ঘর-ভিটে না থাকায় একসময় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করতাম আমরা। নিজের নামে রেজিস্ট্রিযুক্ত ঘর ও জমি পেয়ে এখন আমরা চিন্তাহীন। মাথা গোঁজার ঠাঁই হওয়ায় নিজেকে আগের মতো অসহায় ভাবি না। এছাড়া আমাদের স্ত্রীরাও হাঁস-মুরগী, গরু ও ছাগল পালন করায় ভালই চলছে সংসার।

প্রকল্পের বাসিন্দা তানিয়া আক্তার বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পে রয়েছে বিদ্যুৎ সুবিধা। বিশুদ্ধ পানির জন্য তিনটি নলকূপ আছে। এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকা লোকদের সন্তানরা স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতে যায় নিয়মিত। আগে ছিল অনিশ্চিত জীবন। ঘর পেয়ে এখন আমরা নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি।

সরেজমিনে মাদার্শা আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে কথা হয় ওই আশ্রয়ণে বসবাসকারীদের সাথে। তারাও ছদাহা আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতোই নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঠাঁই পেয়ে তারা এখন সামাজিক মর্যাদার কথা ভাবছেন। নিজেদের সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার আাশা ব্যক্ত করেন তারা।  পাশেই এওচিয়া ইউয়িনের এওচিয়া মৌজায় গিয়ে দেখা যায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরো ৪৮টি ঘর রয়েছে এখানে। সেখানকার বাসিন্দারা এখন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখছেন।

 

আশ্রয়ণ প্রকল্পঃ একেকটি গৃহ প্রান্তিক মানুষের সামাজিক মর্যাদার প্রতিক হয়ে উঠেছে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

ছদাহা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোসাদ হোসেন চৌধুরী ও মাদার্শা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু নঈম মোহাম্মদ সেলিম বলেন, এখানে যারা ঘর পেয়েছে, তারা এক সময় আশ্রয়হীন ছিল। নিজস্ব কোন ঘর-ভিটে না থাকায় অনিশ্চয়তায় কাটতো তাদের জীবন। এখন তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার পাশাপাশি তাদের বেড়েছে আত্মমর্যাদাও।  সাতকানিয়া-উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, একজন লোকও গৃহহীন থাকবে না। এ ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিটি মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবেন বলে আশা করি।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, বিভাগের ১১ জেলায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে ৩৬ হাজার ৭১৫ টি গৃহহীন পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় ৪ হাজার ৭১১, কক্সবাজার জেলায় ২ হাজার ৬৭৯, কুমিল্লায় ৩ হাজার ৫৪, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় ৫ হাজার ৮৩০, চাঁদপুর ১ হাজার ১০৬, নোয়াখালীতে ৬ হাজার ১ টি, ফেনীতে ১ হাজার ৩৮৪, লক্ষ্মীপুরে ৩ হাজার ২২৮, রাঙামাটিতে ১ হাজার ৪৫১, খাগড়াছড়িতে ৪ হাজার ২৪২ এবং বান্দরবানে ২ হাজার ৯১২ পরিবার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বরাদ্দকৃত ঘরে মৌলিক সুবিধাগুলোসহ বসবাসের সুযোগ পেয়েছে।

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বাস্তুচ্যুত ৪ হাজার ৪০৯ দরিদ্র পরিবারকে কক্সবাজারে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা যায়, তাদের পুনর্বাসনের জন্য ১৩৯টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প। ২০টি ভবনের কাজ শেষ করে ইতিমধ্যে ৬৪০টি পরিবারকে এখানে পুনর্বাসন করা হয়েছে। প্রকল্প অফিস সুত্রে জানা যায়, চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জেলায় অর্ধশতাধিক বহুতল ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে।

 

আশ্রয়ণ প্রকল্পঃ একেকটি গৃহ প্রান্তিক মানুষের সামাজিক মর্যাদার প্রতিক হয়ে উঠেছে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

 

আরও দেখুনঃ 

দুদক আইনজীবী : বিএসএমএমইউ’র প্রিজন সেল রিসোর্টে পরিণত হয়েছে

প্রকল্প অনুমোদন একনেকে ২,২১৬ কোটি টাকার ১০টি প্রকল্প

Leave a Comment