‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] এস এ মালেক

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] এস এ মালেক

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বাধীনতার জন্য কালজয়ী এক ঘোষণা। ভাব, ভাষা, শব্দচয়ন এবং বাস্তবতার বিবেচনায় ওই ভাষণ ছিল অসামান্য ও অদ্বিতীয়। শিরোনামধৃত অংশটি এ ভাষণের সর্বশেষ বাক্য । ভাষণের একটাই উদ্দেশ্য জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতা অর্জন ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ থেকে উচ্চারিত স্বাধীনতার সংগ্রামের সর্বশেষ আহ্বানটি মুহূর্তেই উপস্থিত লাখো জনতার মাঝে বিদ্যুতের মতো স্ফুরণ ঘটায় এবং তাদের অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করে। ওই সময়ে তারা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে বজ্রনিনাদে ফেটে পড়ে।

উদ্ধৃত বাক্যে বঙ্গবন্ধু প্রথমে মুক্তি ও পরে স্বাধীনতার কথা বলেন। পাকিস্তানের আধা ঔপনেবেশিক স্বৈর শাসনের কবলে পড়ে বাংলার জনগণ যে দুঃশাসন, শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিল তা থেকে বাংলার জনগণকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। মুক্তি বলতে তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সার্বিক মুক্তির কথা বলেছিলেন।

তিনি চেয়েছিলেন সকল প্রকার সামন্তবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তি। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের কবল থেকে মুক্ত করতে হলে একমাত্র স্বাধীনতা ছাড়া তা আর কোন উপায়ে অর্জন সম্ভব নয় ।

বাংলার জনগণের হাসি, কান্না, দুঃখ বেদনা বঙ্গবন্ধুর হৃদয়কে বিশেষভাবে আলোড়িত করত। তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানি স্বৈর শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট নিপীড়িত ও নির্যাতিত জনগণের মুখে হাসি ফোটাতে । তাই তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা অর্জনের জন্য তাঁকে প্রায় দেড় দশক কারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছে সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানের আধা ঔপনিবেশিক সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে।

১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলন ও সংগ্রাম হয়েছে তাতে নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সুসংহত করার লক্ষ্যে তিনি তাঁর ৬ দফা পেশ করেন। ওই ৬ দফার আন্দোলনই বাংলার জনগণকে পাকিস্তানের শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ করে।

৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনের কারণে ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সফল হয় । সামরিক শাসক আইউব খানের শাসনের পতন ঘটে ও জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতাসীন হন। ওই গণঅভ্যুত্থানের পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেনারেল ইয়াহিয়াকে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য করেন।

তিনি প্রথমে বললেন মুক্তির কথা, তারপর স্বাধীনতার কথা । মুক্তি বলতে তিনি তাঁর জনগণের সার্বিক মুক্তির কথাই বলেছিলেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন, নিপীড়ন ও শোষণ-বঞ্চনা থেকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছিল ওই ভাষণে। বলা হয়েছিল সকল প্রকার সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত থেকে মুক্তির কথা । বাংলার মানুষের মুক্তিই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য। – বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ

এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ‘৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ওই নির্বাচনের রায়ই ছিল ৬ দফার ম্যান্ডেট । তাই নির্বাচনের পর পরই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শাসকবর্গকে ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য চাপ দেন।

পাকিস্তানি শাসকেরা বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রলোভন দিয়ে ৬ দফার প্রশ্নে আপস করবার চেষ্টা চালায়। তারা রাজনীতিবিদদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বসে। সেখানে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না, তিনি চান বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

তারপর শুরু হয় চক্রান্ত। বঙ্গবন্ধুর আপসহীন মনোভাব জানার পর পাকিস্তানি শাসকেরা ৩মার্চের আহূত সংসদের অধিবেশন ১মার্চ বাতিল করে। এরপর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে আনা শুরু হয়। ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। তখন আন্দোলন ও সংগ্রামকে আরো জোরদার করার জন্য তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ওই আন্দোলন প্রায় ২৫ দিন চলে ।

বঙ্গবন্ধুর ওই অসহযোগ আন্দোলন ছিল বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিস্ময়কর এক ঘটনা। একজন জননেতা শুধু জনগণের উপর নির্ভর করে, জনগণের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে যে অসাধারণ শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম তা বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করে গেছেন। ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে তিনি তখনকার ক্ষমতাসীন পাকিস্তান সরকারকে অকার্যকর করে দেন।

অসহযোগ আন্দোলনের ওই ২৫ দিন একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিল না। পাকিস্তানের একটা পতাকাও কোথাও উড়তে দেখা যায় নি। জয় বাংলা ধ্বনিতে তখন বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত। বাংলার স্বাধীনতার স্বাদ তখন বাঙালি উপভোগ করতে শুরু করেছে।

ওই আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেন যে পূর্ব বাংলা শাসন করবার কোন রাজনৈতিক বা আইনগত অধিকার পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নাই । পাকিস্তানভিত্তিক জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসতে না দিয়ে পাকিস্তান মূলত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

তখন স্বাধীনতা অর্জন ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার। এভাবে একজন রাজনীতিবিদ যার কথায় তখন পূর্ব বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছিল, জনগণের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে তিনি একটা রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বেই রাষ্ট্র শাসন প্রক্রিয়া পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা বিশ্বে অদ্বিতীয় ঘটনা ।

আসলে যারা স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সুদীর্ঘ চার দশক ধরে বিতর্ক করছেন এবং জেনারেল জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করছেন তাদের কাছে জিজ্ঞাসা ৭ই মার্চের ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার আর কোন প্রয়োজন ছিল কি?

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে ঘোষণাই ছিল প্রকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চের কালরাতে গ্রেফতার হবার পূর্বেই যে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন তা সংবিধানস্বীকৃত । মূলত ৭ই মার্চের ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ উচ্চারণ করেই বঙ্গবন্ধু ক্ষান্ত হননি।

তাঁর বক্তব্যে ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে এক সুনির্দিষ্ট নির্দেশনামা। একজন সিভিলিয়ান নেতা কি করে গেরিলা যুদ্ধের নির্ধারিত নীতিসমূহ নিখুঁতভাবে ঘোষণা দিতে পারেন তা ভাবতেও অবাক লাগে । বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।

একই সঙ্গে তিনি জনগণকে চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকারও নির্দেশ দেন। তাঁর ওই ভাষণ বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী জনগণ জাতীয় স্বাধীনতার যে স্বপ্নকে লালন করত তারই প্রতিফলন।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছিলেন হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে উৎখাত করে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে। সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ করবার জন্য যা যা প্রয়োজন তা করার নির্দেশ ছিল । তাঁর নির্দেশে বাংলাদেশের নদ-নদী, রাস্তা-ঘাট, নগর-বন্দর সব স্থানে সেনাবাহিনীর যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল।

বঙ্গবন্ধু সেনাছাউনিতে সব সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি বাঙালি পাচকদের সেনাবাহিনীর জন্য খাবার রান্না করতে নিষেধ করা হয়েছিল। কী ভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করে দেশ স্বাধীন করতে হবে তারই দিক নির্দেশনা ছিল ৭ই মার্চের ভাষণে।

তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান । যে স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ সমরে হানাদার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত । যে স্লোগানে হানাদার বাহিনীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত। এমন কোন ভাষণ বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশ্যে দেননি, যার শেষে জয় বাংলা বলে বাক্য শেষ করেননি।

৭ই মার্চের ভাষণের প্রতিপাদ্য বিষয় যদিও ছিল ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তবু তা শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে।

[ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] ]

লেখক: ডা. এস এ মালেক

উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] এস এ মালেক
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] এস এ মালেক
আরও পড়তে পারেন :

 

Leave a Comment