“জয় বাংলা” [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

৭ই মার্চের ভাষণ : ‘জয় বাংলা’ কে আমাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের একটি স্লোগান হিসেবে ভাবেন। কিন্তু ‘জয়-বাংলা’ শুধু আমাদের রণধ্বনি নয়, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র। এককালে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিটি যেভাবে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের মনে স্বদেশ চেতনা জাগ্রত করেছিল এবং সকল স্তরের বাঙালি হিন্দুদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল ‘জয়-বাংলা’ ধ্বনিটি তেমনি শুধু বাংলার এক সম্প্রদায়ের মানুষকে নয়, সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

‘বন্দেমাতরম’ স্লোগানটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বলিষ্ঠ স্লোগান হলেও তা সম্প্রদায়গত প্রাচীর ততটা ডিঙাতে পারেনি । কিন্তু ‘জয় বাংলা’ কোনো সম্প্রদায়গত চেতনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে।

‘জয়-বাংলা’ ধ্বনিটি স্লোগান হিসেবে শুরু হয়েছে, ‘জয়-বাংলা’ উচ্চারণের মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মাহুতি দিয়েছেন; আবার লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে যেদিন স্বাধীনতা অর্জিত হয় সেদিনও সারা বাংলার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে কোটি কণ্ঠে মন্ত্রিত হয়েছে ‘জয়-বাংলা’র বজ্রধ্বনি ।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যেদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন, তারপর ঐতিহাসিক এই ভাষণটি শেষ করেন ‘জয়-বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে, সেদিনও তাঁর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে লাখো জনতা উচ্চারণ করে ‘জয়-বাংলা’।

বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে,  অনেকেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেন। লিংকনের ছোট্ট এই ভাষণের মধ্য দিয়ে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অবসান হয়ে ঐক্যবদ্ধ মার্কিন জাতির অভ্যুদয় ঘটেছিল। আর বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির নবঅভ্যুদয় ঘটে, পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন একটি স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব অঙ্কিত হয়; আর এই অস্তিত্বের নাম বাংলাদেশ।

‘বন্দেমাতরম’ স্লোগানটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বলিষ্ঠ স্লোগান হলেও তা সম্প্রদায়গত প্রাচীর ততোটা ডিঙাতে পারেনি কিন্তু ‘জয় বাংলা’ কোন সম্প্রদায়গত চেতনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে। – ৭ই মার্চের ভাষণ

বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সবচেয়ে বড়ো তুলনা ‘জয়-বাংলা’ স্লোগান এটি কোনো দলের স্লোগান নয়, কোনো অস্থায়ী ধ্বনি নয়- এটি বাঙালি জাতির সমগ্র অংশের জাতীয় সত্তা থেকে উদ্ভূত বজ্রনিনাদ এই স্লোগানকে কণ্ঠে ধারণ করে বাঙালি বার বার তাদের স্বাধীনতার শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছে এবং সফল হয়েছে।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

স্বাধীনতার শত্রুরা তাই, ‘৭৫-এ নির্মম ট্র্যাজেডির পর সবার আগে ‘জয়-বাংলা’ ধ্বনিটি মুছে দিতে চেয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামটি ইতিহাস থেকে লুপ্ত করতে চেয়েছে। জাতিকে ভোলাতে চেয়েছে তার স্বাধীনতার মৌলিক আদর্শগুলোর কথা; কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। দুটি নাম বাঙালির অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন সত্তার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। এর একটি হলো- ‘বঙ্গবন্ধু’, আরেকটি ‘জয়-বাংলা’ স্লোগান।

লিংকনের গেটিসবার্গের ভাষণ যেমন দুইশতক পরেও আমেরিকার জনগণের ঐক্যের শক্তি, তেমনি বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণও বাংলাদেশের মানুষের ঐক্য ও স্বাধীন অস্তিত্বের ভিত্তি। তাই বঙ্গবন্ধুর নামটি যেমন শত চক্রান্ত করেও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি, তেমনি পাকিস্তান থেকে ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি আমদানি করেও বাঙালির কণ্ঠ থেকে ‘জয়-বাংলা’ স্লোগানটিকে উচ্ছেদ করা যাবে না।

‘৭১এর যুদ্ধাপরাধীদের চরম দণ্ডের দাবিতে শাহবাগ চত্বরে যে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটে সেখানে নিনাদিত হতে থাকে ‘’জয়-বাংলা’ স্লোগান। এটি লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত ঐক্যের সুর হয়ে মিশে যায় সারা বাংলায় পরবর্তীকালে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুদের চূড়ান্ত পরাজয়ের সূচনা।

‘জয়-বাংলা’ শুধু একটি স্লোগান নয়। এটি আমাদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয় সত্তার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। এই স্লোগান লাখো শহীদের রক্তমাখা, সম্ভ্রমহারা অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধার আর্তবিলাপ মিশ্রিত এবং কোটি কোটি মানুষের বিজয়ের উল্লাসে উদ্দীপ্ত।

এই ‘জয়-বাংলা’ স্লোগানটি বর্তমানে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদী উত্থানের বিরুদ্ধেও আমাদের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার এই ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে জাতির পিতার কণ্ঠে এবং বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিটি সংগ্রামে । এই স্লোগানটি বাঙালিরা ধারণ করে রাখলে তা সব সময় সত্যের সাহস যোগাবে এবং তাদের প্রতিটি সংগ্রামে বিজয়ী করবে ।

[ “জয় বাংলা” [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] ]

লেখক :

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট

[ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমাদের ভাষা দিবসের অমর গান “আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি” এর গীতিকার। তিনি নিয়মিত বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ক কলাম লেখেন। কলামিস্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে যারা দেখেছিলেন তাদের মধ্যে আবদুল গফফার চৌধুরী অন্যতম]

 

“জয় বাংলা” [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আরও পড়তে পারেন :

Leave a Comment