প্রথম অভিযান [ স্বাধীনতা ‘৭১ ] কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

প্রথম অভিযান [ স্বাধীনতা ‘৭১ ] : হাইকমান্ড নেতৃবৃন্দ তাঁদের দপ্তরে বসে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে প্রশাসনযন্ত্রের নানা শাখা থেকে প্রশাসন প্রধানরা একেএকে তাঁদের বিভাগের আনুগত্য প্রকাশ করছেন। এই আনুগত্য প্রকাশে কেউ বাদ নেই———ব্যাঙ্ক, বীমা, আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা থেকে শুরু করে বিচার ও শাসন বিভাগ সকলেই একে-একে তাঁদের নিঃশর্ত আনুগত্যের শপথ নিচ্ছেন।

এই সময় কাগমারী বেতারে ২৫ মার্চ ‘৭১ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ধরা পড়ে ঃ

Pak-Army suddenly attacked E.P.R. Base at Pilkhana, Rajarbag Police Line and Killing citizens. Street battle are going on in every streets of Dhaka-Chittagong. I appeal to the Nations of the world for help. Our freedom-fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland. I appeal and order you all in the name of Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country.

Ask Police, E. P. R.. Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight, no compromise, victory is ours. Drive out the last enemy the holy soil of motherland. Convey this message to all Awami League leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. May Allah bless you. Joy Bangla.

SK. Mujibur Rahman.

26.3. 71

প্রথম অভিযান [ স্বাধীনতা '৭১ ] কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম - Kader Siddique, Bir Uttom [ কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ]
Kader Siddique, Bir Uttom [ সামনে জনযুদ্ধ, চাই সশস্ত্র প্রস্তুতি [ স্বাধীনতা ‘৭১ ] কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ]

[ প্রথম অভিযান [ স্বাধীনতা ‘৭১ ] কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ]

পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনী ঢাকার পিলখানা ও রাজারবাগে পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্ ও পুলিশবাহিনীর উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালিয়েছে। বহু নাগরিক নিহত। ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরের পথে-পথে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলেছে। আমি বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে শত্রুর মোকাবেলা করছে। আমি সবাইকে আহ্বান করছি, নির্দেশ দিচ্ছি, সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে সামিল হউন।

পুলিশ, পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং আনসার বাহিনীকেও শত্রুর প্রতি রুখে দাঁড়াবার জন্য আপনারা আহ্বান জানান। শত্রুর সাথে কোন আপোস নাই। আমাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে উৎখাত করুন। আমার এই বার্তা সকল আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী, অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। জয় বাংলা।

শেখ মুজিবুর রহমান

২৬.৩.৭১

Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 4 প্রথম অভিযান [ স্বাধীনতা '৭১ ] কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম [ Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman]
এই বার্তা দুজন পুলিশ দিয়ে টাঙ্গাইল থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব বদিউজ্জামান খান থানায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি গ্রহণ করেন এবং প্রচার বিভাগকে সর্বত্র প্রচার করতে নির্দেশ দেন। বদিউজ্জামান খান, সৈয়দ আবদুল মতিন ও লতিফ সিদ্দিকী ২৬ মার্চ সারাদিন স্থানীয় লোকজনদের কাছ থেকে রিভলবার, পিস্তল ও একনলা-দোনলা বন্দুক সংগ্রহ করে আমাদের মধ্যে বিতরণ করেন।

সারাদেশে তখন পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের সবুজ লাল ও সোনালি তিনরঙা পতাকা উঠানো হয়েছে। সারা বাংলায় লক্ষলক্ষ উড্ডীয়মান বাংলাদেশের পতাকার মাঝে সেনা ছাউনিগুলিতে তখনও দু’একটি পাকিস্তানী পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছিল। টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসেও বিষফোঁড়ার মতো একখানা পতাকা পত্পত্ করে উড়ছিল। এটা টাঙ্গাইলবাসীর কাছে বড় বেমানান, বড় যন্ত্রণাদায়ক ঠেকছিল। আমার মনেও পতাকাটি কাঁটার মতো প্রতিমুহূর্তে বিধছিল।

তাই ২৭ মার্চ, দুপুরে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে টাঙ্গাইল সার্কিটহাউসের সৈন্যদের ব্যাপারে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সার্কিটহাউসের মিলিটারিদের ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করে ফেলা উচিত।

কারণ একাধারে হাজার হাজার বাংলাদেশের পতাকার মাঝে একখানা পাকিস্তানী পতাকা যেন পাকিস্তানের অস্তিত্ব ঘোষণা করে চলেছে, তেমনি এই সেনারা যদি রাতের আঁধারে আচমকা শহরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে সহজেই আমাদের ছত্রভঙ্গ করে ফেলতে পারবে। শত্রু নয়, বন্ধু নয়, এমন একটি সশস্ত্র দলকে একেবারে পেটের ভিতরে থাকতে দেওয়া যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই সমীচীন নয়।”

Kader Siddique, Bir Uttom [ কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ]
Kader Siddique, Bir Uttom [ কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ]
বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী, পরিষদ চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খান ও উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামানের সাথে সার্কিটহাউসের মিলিটারিদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সত্যিই এটা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। যেহেতু সার্কিটহাউসের সৈন্যরা প্রায় সকলেই বাঙালি, সেইহেতু তারা যদি আমাদের সাথে যোগদান নাও করে, তারা যাতে আমাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেটা দেখা উচিত। কিংবা তাদেরকে অন্য কোন উপায়ে কাবু করে অস্ত্রগুলো নিজেদের করায়ত্ত করা যায় কিনা, তার চেষ্টা করা উচিত।

ঘটনাচক্রে এদিন থেকেই আমার উপর টাঙ্গাইলের পুলিশকোথের যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া সার্কিট হাউসে সৈনিকদের সংখ্যা কত, মনোভাব কি, উদ্দেশ্য কি এবং কোন উপায়ে তাদের আমাদের প্রতি অনুগত করা যায়— এইসব যাবতীয় খোঁজখবর নিয়ে কার্যে রূপায়ণের সমস্ত দায়িত্ব উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামানের পরামর্শে সর্বাধিনায়ক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আমার উপর ছেড়ে দেন। এই গুরুদায়িত্ব অর্পণে হয়তো তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, যেহেতু আমি কিছু সময়ের জন্য সেনাবাহিনীতে ছিলাম, সেইহেতু আমার পক্ষে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যাপার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হতে পারে।

দায়িত্ব পাবার পর আমি খুব উৎসাহিত হয়ে সার্কিটহাউসের সৈন্যদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করি। সহকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে নানাভাবে খোঁজখবর নিয়ে সন্ধ্যার দিকে জানতে পারলাম যে, এরা দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি। সৈন্য সংখ্যা ১৫০ জন। দুইজন পাঞ্জাবি অফিসার ছাড়া সকলেই বাঙালি। এদের ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার ঢাকার জয়দেবপুরে। তারা ১৩ মার্চ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে টাঙ্গাইলে এসেছে এবং সেইদিন থেকে সার্কিট হাউসে অবস্থান করছে।

‘৭০-এর নির্বাচনের পর পাকিস্তানীদের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, বাঙালি সৈন্যরা যদি ছাউনিতে সংঘবদ্ধভাবে থাকে তাহলে সংকটময় পরিস্থিতিতে হয়তো তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। সংঘবদ্ধভাবে বাঙালি সৈন্যরা যদি বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাহলে তা সামাল দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে, অসম্ভবও হতে পারে। সেইজন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিল। সেসময় যে সাতটি পূর্ণ ও একটি অসম্পূর্ণ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল, তাদেরকে সুকৌশলে বিভক্ত করে রাখতে পাকবাহিনী সক্ষম হয়েছিল।

পাকিস্তানী সামরিকচক্রের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সৈন্যরা যতক্ষণ পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুগত থাকবে, ততক্ষণ তারাই বাঙালিদের আন্দোলন দাবিয়ে রাখুক। আর খণ্ডখণ্ড ছড়ানো-ছিটানো বাঙালি সৈন্যরা যদি বিদ্রোহ করেও বসে, বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অল্প অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানী মিলিটারিদের উপর তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। অন্যদিকে পাকিস্তানী মিলিটারিদের ছাউনিতে রেখে শক্তি সুসংহত করাই তাদের উদ্দেশ্য। এই কৌশল ২৫ মার্চ পর্যন্ত তারা অত্যন্ত সফলতার সাথে চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। টাঙ্গাইলে যে-কোম্পানিটি এসেছিল, সেও ঐ একই কারণে।

On January 24 in 1972, Kaderia Bahini leader Abdul Kader Siddique surrenders arms of his fellow freedom fighters to Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman at Bindubasini Boys High School ground in Tangail
On January 24 in 1972, Kaderia Bahini leader Abdul Kader Siddique surrenders arms of his fellow freedom fighters to Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman at Bindubasini Boys High School ground in Tangail

তবে এই সৈন্যদল ১৩ মার্চ টাঙ্গাইল আসার পর ২৭ মার্চ পর্যন্ত কোনদিন কখনও মহড়া দিয়ে শহরে আসেনি। যাওবা দু’একজন এসেছে তারাও সাধারণ পোষাকে। সার্কিটহাউসে সৈন্যদের ব্যাপারে অনুসন্ধানের তথ্য যখন জানানো হল, তখন হাউকমান্ড বিচার-বিবেচনায় বসলেন। যেহেতু পুলিশ-আনসারারা সবাই আমাদের পক্ষে, সেহেতু মিলিটারিদের শান্তিপূর্ণভাবে অথবা প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে দলে আনা যায় কি না।

ডি.সি., এস.পি., আনসার এ্যাডজুটেন্ট ও আমাদের গণবাহিনীর সাথে ব্যাপক আলোচনা করে হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিলেন, রাতেই সার্কিটহাউস ঘেরাও করতে হবে। পরিকল্পনামতো, রাত নয়টায় পরিষদের নেতারা গণবাহিনীর চল্লিশ-পঞ্চাশজন সশস্ত্র যুবককে নিয়ে জেলা শহরের রিজার্ভ পুলিশের হেডকোয়ার্টারে এলেন। রিজার্ভ পুলিশের তিরিশ-চল্লিশজন সার্কিটহাউস অভিযানে আমাদের সাথী হলো। সশস্ত্র পুলিশদের পেয়ে আমরা বেশ উৎসাহিত হলাম। এতক্ষণ যারা ছিলাম তারা প্রায় সবাই ছাত্র, শ্রমিক, রিকশাঅলা ও দু’একজন আনসার।

পুলিশরা যোগ দেওয়ায় আমাদের শক্তি আরো বৃদ্ধি হলো। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ অভিযানের সফলতা কামনা করে প্রত্যেকের সাথে বুকে বুক মিলিয়ে বিদায় জানালেন। বদিউজ্জমান খান, খোন্দকার আসাদুজ্জামান, ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আমাদের বিদায় জানিয়ে দুরুদুরু বুকে অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন।

আমরা সত্তর-পঁচাত্তরজন প্রথম অভিযানে চলেছি। অস্ত্রের মধ্যে পুলিশ, আনসারের পুরোনো রাইফেল ও দু’একটা মান্ধাতা আমলের ব্রেটাগান। অভিযান সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ার জন্য ২টি আর.বি. কেন্দ্র ঠিক হয়। একটি হাইকমান্ড অফিস, অন্যটি রিজার্ভ পুলিশ হেডকোয়ার্টার। আমরা খুব সন্তর্পণে বিবেকানন্দ আশ্রমের পাশ দিয়ে লৌহজং নদীর পাড় ঘেঁষে এগুচ্ছি। এমন সময় আমাদের সাথে ফজলুর রহমান এসে যোগ দিলেন। ফজলুর রহমান প্রাক্তন সৈনিক। তাঁকে পেয়ে আমরা আরও উদ্বুদ্ধ হলাম।

ফজলুর রহমান আমাদের সাথেসাথে শ্মশানঘাট পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। আমরা বেশ সন্তর্পণে এগুচ্ছি। হঠাৎ একটু দূরে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহে রোডের কোদালিয়া পুলের উপর থেকে কে বা কারা সার্কিটহাউস লক্ষ করে তিন চার রাউন্ড গুলি ছোড়ে। আমরা তখনও সার্কিটহাউস থেকে হাজার গজ দূরে। গুলির জবাবে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সার্কিটহাউস থেকে চাইনিজ মেশিনগান গর্জে উঠল। আমরা সাথেসাথে উল্টেপাল্টে যে যেদিকে পারলাম হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম [ Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম [ Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman]
গুলি কোন দিকে হচ্ছে, সেদিকে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু কচ্ছপের মতো মাটি খামচে আড়াল নিয়ে জীবন বাঁচাবার চেষ্টা করছি। আমরা সবাই তখন দিশেহারা হয়ে গড়াগড়ি করছি। হঠাৎ কানে এল, ‘হে আল্লাহ একেবারে মরছি’। পাশে আরেকজন বলল, ‘বাবাগো, মাগো গেছি গো’, অন্যদিক থেকে ভেসে এল, বোধহয় মা-বাবারে আর দেখবার পারমু না।

কিসে যে মরবার লাইগ্যা আইলাম। শালাগোরে খাইয়া কাম নাই। আমাগো আগে পাঠাইয়া দিয়া শালা আর, আই. এস. পি., নেতারা আরামে বইস্যা মজা দেখত্যাছে। আমরা অইলাম পুলিশ। আমাগো কি যুদ্ধের ট্রেনিং আছে, যে যুদ্ধ করমু?’ এইসব কথা মিনিট দুই শুনলাম। তারপর শ্মশানের নীরবতা।

সার্কিটহাউস থেকে ছোড়া মেশিনগানের গুলির ভয়ঙ্কর শব্দে সবার বুক থরথর করে কাঁপছে। টাঙ্গাইলবাসীরা এর আগে হয়তো কোনদিন মেশিনগানের গুলির শব্দ শুনেননি। আমি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে আড়াই বছর ছিলাম। ‘৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের লড়াইয়ে নিজে প্রত্যক্ষভাবে ছিলাম।

মেশিনগান, ট্যাঙ্ক ও ভারি কামানের মুহুর্মুহু গুলি ও গোলা আশেপাশে পড়তে দেখেছি। কিন্তু ২৭ মার্চ রাতে সার্কিটহাউস থেকে ছোড়া মেশিনগানের গুলির আওয়াজে আমার বুকও থরথর করে কাঁপছিল। মেশিনগানের আওয়াজ যে এত বিকট, গগনবিদারী হতে পারে—পশ্চিম পাকিস্তানের মরু অঞ্চলে যুদ্ধ করেও তেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করিনি।

খোলা জায়গার চাইতে জনবহুল বাড়িঘর ঠাসা শহরঅঞ্চলে মেশিনগানের প্রতিটি গুলির নিদারুণ বুকফাটা আওয়াজ আমাদের দিশেহারা করে ফেলেছিল। মুহূর্তে সারা শহরে কান্নার রোল পড়ে যায়। ঘরবাড়ি, হাজার মানুষ যতক্ষণ গুলি চলে ততক্ষণ আমি উপুড় হয়ে মাটি আঁকড়ে ছিলাম। কয়েক মিনিট পর ভর্জনগর্জন বন্ধ হলে ডাকাডাড়ি শুরু করলাম। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার।

সোহরাওয়ার্দী, এ. খান আজাদ, মনীন্দ্রমোহন ঘোষ, ইকবাল, আবদুস সবুর খান, রিকশাঅলা আলী হোসেন আরো সাত-আট জন ছাড়া বাকি সবাই উধাও। নেই। একজন পুলিশেরও নেই। আমরা বুকে হেঁটে আস্তেআস্তে একজায়গায় জড়ো হয়ে, হাকিহুকি করে কথা বলে ঠিক করলাম, আমাদের কিছুটা পিছিয়ে যাওয়া উচিত। বিবেকানন্দ স্কুলের বটতলা পর্যন্ত পিছিয়ে এসে আলোচনায় বসলাম, এখন আমাদের কর্তব্য কী!

আলোচনার একপর্যায়ে সবুর বলে “অক্ষণি আমাগো আওয়ামী লীগ অফিসে যাইয়া দেহা দরকার, হাইকমান্ড কনে? নেতাগো খুঁইজা বাইর করন লাগবই। এই যে পুলিশরা পলাইয়া গেল, এর একটা রিপোর্ট অক্ষণি হাইকমান্ডরে দেওন উচিত। আমি মূর্খসূর্খ মানুষ। নেহাপড়া জানি আমার বিচারে কয়, যুদ্ধের বিষয় খবর-টবর সাথেসাথে কমান্ডাররে দিতে

সবুরের কথাগুলো সকলেই সমর্থন করল। আমারও মনঃপূত হলো। তাই আমরা পুরোনা শহরে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে এসে দেখি এক হুলস্থুল কারবার। সকলেই উদ্বিগ্ন, আর্মির গুলিতে শহরে যে বিশৃঙ্খলা ও ভয়ার্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে নেতারা ভীষণ উৎকণ্ঠিত। বিশেষ করে আমরা সার্কিট হাউস আক্রমণ করতে গেছি, আর সেই সার্কিটহাউস থেকে গুলি হয়েছে।

গুলিতে আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা, আমরা জীবিত আছি কিনা, কিভাবে আমাদের সংবাদ পাওয়া যাবে—এ সমস্ত চিন্তা-ভাবনা নিয়ে হাইকমান্ড যখন চিন্তিত, তখন আমরা উদ্ধু চুল, চোখমুখ লাল, ধূলি-কাদা গায়ে হতাশ অবস্থায় ভূতের মতো তাদের সামনে হাজির।

আমাকে দেখে সর্বাধিনায়ক লতিফ সিদ্দিকী ছুটে এসে জাপটে ধরেন। তারপর একে একে অন্যদেরও জড়িয়ে ধরলেন। আমরা ফিরে এসেছি শুনে, চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান, উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামান ও অন্যান্য নেতারা দৌড়ে এসে আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “গুলি কেন হলো? কী হলো? আমাদের কেউ হতাহত হয়নি তো!” সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে অনুযোগের সাথে আমরা পুলিশদের পিছিয়ে যাওয়ার কথা বললাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম [ Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম [ Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman]
পরে অনেক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো, আপাতত সার্কিটহাউস অভিযান স্থগিত রইল। তখন রাত ১২টা। অনেকেই ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। পরিষদের নেতারা একত্রে থাকবেন বলে মনে হলো। আমরা ১৮জন হাতিয়ারসহ আওয়ামী লীগ অফিসের পাশে ক্ষিতীশবাবুর চায়ের দোকানে ঢুকলাম। সেখানেই জানতে পারলাম প্যাড়াডাইস্-পাড়ার মুসলিম লীগের নজরুল দোনালা বন্দুক দিয়ে ঐ গুলি ছুড়ছে।

পরিষদের সিদ্ধান্ত আমার মনঃপূত হয়নি। চায়ের দোকানে দু’একটা কথাবার্তার পরই বুঝতে পারলাম, সিদ্ধান্তটা আমার মতো অনেকেরই মনঃপূত হয়নি। তাই ঠিক করলাম নিজেরাই আবার সার্কিটহাউস আক্রমণ করা। চা-পান শেষে সাবালিয়া ঘুরে সার্কিটহাউসের পূর্বদিকে সিএন্ডবি-র ইঁটের পাঁজার মাঝে পজিশন নিলাম। যে ইঁটের পাঁজার কাছে দিনে যেতেও ভয় করত, সেই ইঁটের পাঁজার ভিতর অনায়াসে অবলীলায় শুয়ে পজিশন নিলাম। একমুহূর্তের জন্যও সাপখোপের ভয় হলো না। সাব্যস্ত হলো সূর্যোদয়ের মুহূর্তে সার্কিট আক্রমণ করা হবে।

আমাদের থেকে সার্কিটহাউসের দুরত্ব ২০০ গজ। সাপের ভয় এড়াতে পেরেছি, সর্বাধুনিক অস্ত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছি। আমরা প্রতিমুহূর্তে জান দিতে প্রস্তুত। বলতে গেলে সবকিছুই জয় করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু আমাদের সেই বীরদের একঘন্টায় মশা কামড়ে নাস্তানাবুদ করে ফেলল। মিলিটারিদের আক্রমণ করার পূর্বেই মশাকে আক্রমণ শুরু করলাম। অসাবধানে হাত-পা চালাতে গিয়ে স্তূপ থেকে দু’একটা ইট খসে পড়ে শব্দ হওয়ায় সার্কিটহাউস থেকে আমাদের দিকে আবার মেশিনগানের গুলি চলল।

মেশিনগানের গুলির আগুনের ফুলকি আমাদের মাথার উপর দিয়ে শৌশোঁ শব্দে চলে যেতে লাগল। কয়েকমুহূর্ত গুলি চলার পর অবস্থা শান্ত হলে আমরা বুকে হেঁটে ৫০-৬০ গঞ্জ পিছিয়ে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল পাকা রাস্তার পূর্বপাশে এসে আশ্রয় নিলাম। রাত তখন ২টা। সূর্যোদয়ের তখনও আড়াই-তিনঘন্টা বাকি। তাই ওখান থেকে সরে এসে সাবালিয়ায় একটি বাসে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। এখানেও মশা আমাদের পিছু ধাওয়া করল। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে মণীন্দ্রমোহন ঘোষকে মশা তাড়ানোর ঔষধ আনতে দোকানে পাঠানো হলো।

কিন্তু মণীন্দ্রমোহন ঘোষ মশার ঔষধ আনতে গিয়ে খোদ সর্বাধিনায়ককে নিয়ে এসে আর-এক বিপদে ফেলে দিল। বড়ভাই এসে হুড়মুড় করে বাসে উঠে বললেন, “এসব কী হচ্ছে? তোদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমি তো পরিষ্কার মানা করে দিয়েছি, সার্কিটহাউস আক্রমণ করা চলবে না। তোরা তারপর কী শুরু করেছিস?” আমি মৃদুস্বরে বললাম, “না, আমরা সার্কিট হাউস আক্রমণ করতে আসি নাই। আমরা একত্রে শুধু রাতটা কাটানোর জন্যে এসেছি।”— ‘রাখ তোর বাজে কথা।

আমি সব শুনেছি। মণি আমাকে সব চলে দিয়েছে। রাত পোহালেই তোরা সার্কিট হাউসে গিয়ে গুলি ছুড়তি। এরপর শান্ত গলায় স্নেহের সুরে বললেন, “দেখ, তোরা পাগলামি করিস্ না। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। এতে করে তেমন একটা লাভ হবে না। বরঞ্চ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তোরা বাড়ি চলে যা।

রাতটা শেষ হলেই আমরা যার যার মতো চলে যাব। —রাখ তোদের চালাকি। আমি এখান থেকে সরলেই তোরা কাদেরের কথামতো কাজ করবি। আমি তোদের হাতিয়ার আটক করলাম। আমরা পড়লাম মহাফ্যাসাদে। এখন উপায়! স্বয়ং প্রধান সেনাপতি আমাদের হাতিয়ার আটক করলেন। তারপর তাঁর আস্থাভাজন আবদুস সবুর খান ও আর একজনকে পাহারায় রেখে চলে যাবার সময় বলে গেলেন, “আমি যেয়েই ফোর্স ও গাড়ি পাঠাচ্ছি।

এই হাতিয়ার এক্ষুণি অস্ত্রাগারে জমা হয়ে যাবে।” সবুরকে কড়া নির্দেশ দিয়ে বললেন, “দেখ, আমি আশা করি তুমি আমার আস্থা হারাবে না। ঠিকমতো ডিউটি করবে। ওদেরকে অস্ত্রের কাছে ঘেঁষতে দেবে না। তোমাদের দুইজনের হাতে যে অস্ত্র দিয়ে গেলাম তা এই হাতিয়ার রক্ষা করার জন্যে, প্রয়োজনে গুলি ছুড়তেও দ্বিধা করবে না।”

সর্বাধিনায়ক চলে যাবার পর আমরা সবাই বিষণ্নবদনে মনমরা হয়ে বসে আছি। তখন আর মশার কামড় তেমন মালুম হচ্ছে না। সময় সংক্ষিপ্ত, কী করব? সর্বাধিনায়কের আদেশ অমান্য করব? আর কিভাবে করব? হাতিয়ারের দিকে গেলেই সবুর গুলি ছুড়বে। এমনিতে সবুর ভীষণ আইনের লোক।

সোহরাওয়ার্দী খুব আস্তে করে বলল, “আমি সবুর ভাইয়ের সাথে দু’একটা কথা বলে দেখি। কী ফল দাঁড়ায়।’ সোহরাওয়ার্দী হাঁক ছাড়ল,—“কী সবুর ভাই । লাটের হালে আছেন দেখি! আপনারই পোয়াবারো! আপনারে আমরা সবাই ভালোবাসি, আমাগো নেতাও ভালোবাসে। আসলে আপনিই আমাগোর আশা। নেতা তো আপনিই।”

—ছিঃ ছিঃ সোহরাওয়ার্দী ভাই, আমারে আর নজ্জা দিয়েন না। আমি তো আপনাগো সবার লগেই আছি। দেহেন চে, কী বিপদেই না পড়লাম। শালার মিলিটারিগো সাথে পাইট করমু, এদিকে সি-ইন-সি সাব গোলারুদ এ্যারেস্ট কইরা ফেলাইল। এহন করিডা কী?

Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 4 প্রথম অভিযান [ স্বাধীনতা '৭১ ] কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম [ Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman]
সবুরের কথায় আমরা কিছুটা সাহস পেলাম। সবুর আমাদের পূর্ব পরিচিত নয়। আজ সন্ধ্যায় সে আমাদের সাথে পরিচিত ও মিলিত হয়েছে। তখন আমরা কেউ সবুরের কাছে আসল কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। এই সময় আজাদ বলল, “সবুর ভাই, মশার কামড়ে আর পারি না। আমরা একটু গাড়ির নিচে যাই।” সবুর কোন আপত্তি করল না।

বরঞ্চ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল—“আরে বলতাছেন কেন? আপনারা তো আর এ্যারেন্ট না। খালি অস্ত্রগুলো এ্যারেস্ট কইরা গেল। আমি তো খালি অস্ত্রের ডিউটি করতাছি, আপনাগোরতো না!’ আমরা বেরুলাম। অনেক কথাবার্তার পর স্থির হল যে, আমরা একজনকে নেতা বানাব এবং সবুরকে গিয়ে বলব যেহেতু আমরা সবাই নেতার কথা শুনি, সেহেতু আপনাকেও শুনতে হবে।

যদি না শোনেন তাহলে হাইকমান্ডের কাছে আমরা রিপোর্ট করব, আপনি কারো কথা শোনেন না। তাই আপনাকে যেন আর কোনসময় যুদ্ধে না পাঠায়। পরামর্শ করে আমরা গাড়িতে উঠলাম। এবার সবাই কিছুটা অস্ত্রের কাছাকাছি বসলাম। সোহরাওয়ার্দী শুরু করল । –সবুর ভাই, আমার কিছু কথা আছে।

–কন আপনার কী কথা?

–দেখেন, সব জিনিসের একটা আইন আছে তো! আমাগো তো আইন মাইন্যাই চলতে

হবে। তা না হইলে আমরা স্বাধীন হতে পারব না। আমাগোরে যখন পুলিশলাইন থেইক্যা বিদায় করে দিল তখন আপনি তো দেখছেন, পুলিশগো একজন কমান্ডার আছিল।

— আছিলই তো! দুইটা লাল ফিতাঅলা হাওলাদার।

—তাহলে দেখেন। পুলিশগোরে যদি কমান্ডার থাকে, তাইলে আমরা যারা জনসাধারণ আছিলাম আমাগোরে একজন কমান্ডার আছিল।

সবুর লাফ মেরে বলে উঠল, ইয়েস কথা, হক কথা। —আপনি জানেন আমাগো কমান্ডার কে?

—আমি তো ঠিক বুঝবার পারি নাই। কিন্তু টারেটুরে মনে অইল সি.ইন.সি স্যারের ভাই, কাদের ভাই বোধহয় আমাগো নেতা। হে তো ছাত্রগোরও নেতা।

সবুরের কথা শুনে সবাই সোল্লাসে বলল – আপনি ঠিক কইছেন, কাদের ভাইইতো

আমাদের নেতা। সোহরাওয়ার্দী আবার বলল— আপনার মনে নাই, সন্ধ্যায় সময় সবাইকে বলে দেয়া হয়েছে যাকে কমান্ডার করা হবে, তার কথা সবাইকে মেনে চলতে হবে। যদি কমান্ডারের কথা না-মানা হয়, তাহলে তাঁকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। আপনি স্বীকার করেন তো যে আমাদের কমান্ডার কাদের ভাই।

—হ্যাঁ, স্বীকার করি তো।

-তাহলে কাদের ভাইয়ের কথা না শুনলে আমাদের কী হবে? সবুর জোর দিয়ে বলল – তাইলে তো সবার জেল হইয়া যাইব।

—তাইলে দেখেন আমাদের কমান্ডার হুকুম দিয়েছে, হাতিয়ার নিয়ে নিতে, এখন আমরা কী করি? আমরা তো আমাদের হাতিয়ার নিয়ে নেব। আপনি গুলি করলে করেন। তাইলে আর পাকিস্তানীদের গুলিতে মরতে হবে না। নিজের ভাইয়ের গুলিতে মরব। এর চাইতে শান্তি, এর চাইতে বড় পাওয়া আর কী আছে!’ এই বলে সোহরাওয়ার্দী মহানাটকীয় ভঙ্গিতে কেঁদে ফেলে আস্তেআস্তে অস্ত্রের কাছে এগিয়ে যায় আর কি!

সোহরাওয়ার্দী কথায় সবুরও খুব চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছিল। সবুর বলল— সোহরাওয়ার্দী ভাই, হনেন, হনেন। কাইন্দেন না, কাদেরভাইতো আমারও কমান্ডার। হেতো আমারে বন্দুক দিয়া দিবার অর্ডার দেয় নাই। হে আমারে অর্ডার দেইক্, কাল যদি হাইকমান্ড আমারে এ্যারেস্ট করে তহন আমি কমু, আমার কমান্ডার হুকুম দিছে, আমি অস্ত্র দিয়া দিছি—গুলি করবাইন, জেল দিবাইন, না ফাঁসি দিবাইন, আমার কমান্ডারের দেন গিয়া, আমি আইন মানছি।

সবুর খানকে বললাম, ‘অর্ডার দিচ্ছি। আপনি সব হাতিয়ার দিয়ে দিন।’ সবুর কোন প্রতিবাদ করল না। অনুগত সহযোদ্ধার মতো সবাইকে হাতিয়ার দিয়ে দিল। এভাবেই আধঘন্টার নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটল। আধঘন্টা একটা প্রচণ্ড মানসিক উথালপাথালের পর হাতিয়ার ফিরে পেয়ে আমরা অনেকটা স্বাভাবিক হলাম। হাতিয়ার নিয়ে তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে সোজা কোদালিয়ার দিকে ছুটলাম।

আমরা গাড়ি থেকে এক-দেড়শ’ গজ দূরে যাবার পরই বাসের দিকে ধেয়ে আসা ২-৩টা গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো দেখতে পেলাম। আমরা গ্রামের কাঁচা পায়েচলা আঁকাবাঁকা পথের আশেপাশে লুকিয়ে পড়লাম। গাড়িগুলো এসে বাসের সামনে থামল। ধুপধাপ করে সবাই গাড়িতে উঠল। কিন্তু সব ফাঁকা। কোথাও কিছু নেই। আমাদের আর একমিনিট দেরি হলে হাতিয়ারগুলো হাতছাড়া হয়ে যেত।

Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 2 প্রথম অভিযান [ স্বাধীনতা '৭১ ] কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম [ Kader Siddique Bir Uttom with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman]
রাত ৩টা। কোদালিয়া প্রাইমারি স্কুলে হাজির হলাম। উদ্দেশ্য, বাকি রাতটা কাটিয়ে সূর্যোদয়ের সাথেসাথে সার্কিটহাউস আক্রমণ করব। দুই-তিনজনকে বাইরে নজর রাখতে দিয়ে আমরা চেয়ার-বেঞ্চিতে বসে আছি। বিশ্রাম করছি। সময় কাটাচ্ছি। এখানে তেমন মশার উপদ্রব নেই। সহকর্মীদের মধ্যে দু’তিনজন মত দিল, রাত চারটার দিকে সার্কিটহাউস ঘিরে ফেলা উচিত। অন্য দুজনের মত না, সূর্যোদয়ের আগে কোনক্রমেই নয়। এখানেও কথাবার্তার একফাঁকে সবুর তার নতুন চিন্তার কথা প্রকাশ করল।

সে বলল, “দেহেন, আপনাগোর মধ্যে আমি হইলাম গিয়া সবচাইতে মূর্খ-সুখ নোক। আমার একটা কথা মনে হইছে। আপনারা সবাই যদি পারমিশন দেন, তাইলে কই।” আমরা সবাই সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘তা আপনি বলবেন না তো কে বলবে? বলুন, বলুন, আপনার বুদ্ধি ছাড়া আমাদের কোন কাজই হবে না।” আমাদের কথায় সবুর উৎসাহিত হয়ে বলল, “পাইট দিমু তো! আমাগোর কাছে যে অস্ত্র-শস্ত্র আছে, ওগোরে কাছে তো অনেক বড় বড় অস্ত্র। আমি হুনছি, যুদ্ধে বড় বড় অস্ত্রই লাগে।

আমাগো কাছে তো বড় বড় অস্ত্র নাই, তাই বইলা কি যুদ্ধ বন্ধ রাখন যাইব? ভয় পাইলে চলব? বড় বড় অস্ত্রের কাম বুদ্ধি দিয়া চালান লাগব। দেহেন, আমি একটা কথা কই। আমরা একটা মাইক আনি। আমাগো তো মাইক আনতে কোন অসুবিধা নাই। আমরা মাইকের কাছে গুলি করুম। আর মাইকে হেইডার আওয়াজ মটরের মতো মনে হইব।” সবুরের কথা শুনে সোহরাওয়ার্দী বলল, “আমি একটা কথা বলতে চাই। আমাদের উদ্দেশ্য তো বাঙালি মিলিটারিদের ধ্বংস করা নয়, ওদেরকে আমাদের সাথে শরিক করা।

ওদেরকে যে আমরা চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছি, তা ওদের জানানো উচিত। এবং আমরা কী করতে চাই, সবুর ভাইয়ের পরামর্শমতো মাইকে তা বলতে পারি।” এবার অস্ত্র হিসাবে মাইকের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সূর্যোদয়ের আগে কোথায় মাইক পাওয়া যাবে? মণি, ইকবাল দায়িত্ব নিল, ‘আমরা এক্ষুণি মাইক নিয়ে আসতে পারি। আমাদের মাইক আনতে পারমিশন দেন।’ মণি ও ইকবাল মাইকের জন্য চলে গেলে আমরা সার্কিটহাউসের পাশে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ রাস্তার গা ঘেঁষে অবস্থান নিলাম।

সূর্যের রক্তিম আভা পূর্ব দিগন্তে উদ্ভাসিত। বিশ্বপ্রকৃতির বুকে নবজাগরণের সাড়া প্রকৃতি ও প্রাণীকুল এক নতুন আশার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত। ভোরের আলোয় সার্কিট হাউসে মিলিটারিদের চলাচল লক্ষ করছি। সার্কিটহাউসের অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক নয়। রাতটা ওদের ভালো কাটেনি। রাতে ওরা বেশ কয়েকবার গুলি ছুড়েছে। সারারাতেই ওদের ধারণা ছিল, পাকিস্তানী গেরিলারা ওদেরকে নিরস্ত্র করার জন্য ঘেরাও করেছে। ভোর হলে অন্যদিনের মতো পাকারাস্তা। দিয়ে লোকজন চলাচল শুরু করল। জনসাধারণ আপনমনে যাওয়ার পথে আমাদের রাস্তার পাশে অস্ত্র হাতে শুয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হয়ে গেল।

মাইক এল ভোর সাড়ে পাঁচটায়। একসেট নয়, আট-দশ সেট। তাড়াতাড়ি রাস্তার কোল ঘেঁষে অনেকগুলো মাইকের হর্ন লাগানো হলো। ছটার মধ্যে মাইকে কথা বলা শুরু হয়ে গেল। একটা কথা নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা হলো আমরা তাদেরই ভাই। সাড়ে ছটায় আমি মাউথপিস হাতে নিলাম। মিলিটারিদের উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলাম— “বন্ধুগণ, আজ বাঙালির বাঁচামরার যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে, তাতে সমস্ত বাঙালিই এক ও অভিন্ন। আমরা যদি সকলে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে স্বৈরাচারী পাকিস্তানী শক্তিকে হাত গুটাতে হবে।

২৫ মার্চ রাত বারটার পর থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম। বাংলাদেশের একইঞ্চি জমিতেও বিদেশীশক্তির কর্তৃত্ব বাঞ্ছনীয় নয়। এখন থেকে বাংলাদেশের একমাত্র সেনাবাহিনী হবে বাঙালি এবং তা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। আপনারা যারা বাঙালি তারা আমাদের ভাই। বাংলার লাখো লাখো মানুষ বছরের পর বছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রক্ত পানি করে আপনাদের বেতন জুগিয়েছে। আজ পাকিস্তানীরা আমাদের আক্রমণ করেছে।

তাই স্বাভাবিক কারণে আমরা আপনাদেরকে আমাদের পাশে পেতে চাই। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ, আপনারা আমাদের সাথে শরিক হন, মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করুন। আমি পরিষদ কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা আমাদের সাথে শরিক হন। অন্যথায় শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ রয়েছে। গতরাত থেকে আপনারা চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছেন, আপনাদের সাথে বাইরের যোগাযোগ এখন ছিন্ন।

প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর সেই নীতি—ভাতে মারব, পানিতে মারব অবলম্বন করতেও আমরা পিছপা হব না। আমরা যে মাটি ও আলো-হাওয়ায় মানুষ হয়েছি, আপনারা সেই মাটিরই মানুষ। আমরা একই মায়ের সন্তান। বঙ্গজননীর লাঞ্ছনার প্রতিবাদে আসুন আমরা একত্রিত হয়ে দখলদার পাকিস্তানীদের মোকাবেলা করি। আমরা আপনাদের সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চাই। আমরা আমাদের দূত আপনাদের কাছে পাঠাতে চাই। দূত পাঠানোর প্রথম শর্ত হলো, উভয়পক্ষ থেকে সবুজ পতাকা উত্তোলন। আমরা আমাদের পতাকা উত্তোলন করছি। আপনারাও আপনাদের পতাকা উত্তোলন করুন।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী!

Kader Siddique, Bir Uttom [ কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ]
Kader Siddique, Bir Uttom [ কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ]
বক্তৃতা শেষে করে আমাদের দিক থেকে বাংলাদেশের ছোট্ট একটি পতাকা উত্তোলন করা হলো। একটু পরে দেখা গেল, ওদের দিক থেকে একটা সবুজ কাপড় উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সকলে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী’ শ্লো ফেটে পড়লাম। ইতিমধ্যে রাস্তা আড়াল করে আমাদের পিছনে শতশত লোক সমবেত হয়েছেন। তারাও আমাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে শ্লোগান দেওয়া শুরু করলেন। শ্লোগান শেষে শুরু হলো শলাপরামর্শ, সার্কিট হাউসে কে যাবে? কিভাবে যাবে? খালি হাত, না সশস্ত্র?

নানা শলাপরামর্শের পর সাব্যস্ত হলো, একজন সার্কিটহাউসে যাবে এবং খালি হাতেই। সার্কিটহাউসে যাবার প্রার্থী পাঁচজন। এন. এ. খান আজাদ, ইকবাল, মণীন্দ্রমোহন ঘোষ, সবুর খান ও মিন্টু। প্রার্থী পাঁচজন হওয়ায় দূত পাঠানোয় সমস্যা দেখা দিল। পাঁচজনের সবাই বলল, ‘আপনি যাকে বলবেন সেই যাবে। আমি যাকে বলব সেই সার্কিট হাউসে যাবে, এ তো মহাফ্যাসাদে পড়লাম! কার নাম বলব? সে যদি আর ফিরে না আসে, তখন কী হবে? আর এটা খুবই সত্য, তখন পর্যন্ত আমার মধ্যে নির্দেশ দেবার মতো আত্মপ্রত্যয় ছিল না।

শেষে বাধ্য হয়ে একজনকে বললাম, আমাকে পাঁচটুকরা কাগজ এনে দাও। পাঁচটুকরা কাগজে পাঁচজনের নাম লিখে পকেটে রাখলাম। লটারির মতো অন্য একজন সহকর্মীকে পকেট থেকে মাত্র একটি কাগজ তুলতে বললাম। সহকর্মীর হাত থেকে কাগজ নিয়ে খুলে দেখি মণীন্দ্রমোহন ঘোষের নাম লেখা রয়েছে। মণি প্রথমে যাবে। সবার মনে একটা অজানা আশঙ্কা, সকলের মুখ গম্ভীর, থমথমে। সকলে মণীন্দ্রমোহন ঘোষের সাথে বুকে বুক মিলিয়ে রওনা করিয়ে দিয়ে তার চলার পথে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মণি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাচ্ছে।

আমরা একে অপরের সাথে কথা বলছি। বাঙালির মধ্যে বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই। যদি ওরা বেইমানি করে? তাহলে আমরা কোন কথা শুনব না। সোজা সার্কিটহাউসে গিয়ে উঠব। মরি মরব। তবে দুই-চাউরডা মাইরা মরুম। আমার বুকও ধুকধুক করছে। মণি এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ওদের কাছাকাছি পৌঁছেছে, কিন্তু ওরা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। মণি সার্কিটহাউসের গেটে পৌঁছতেই দেখলাম, ওরা কয়েজন এসে মণিকে আলিঙ্গন করে তার বলল। আমরা কিছুই শুনতে পেলাম না। কারণ আমরা সার্কিটহাউস থেকে ৩০০ গজ দূরে। মণি আবার স্বাভাবিকভাবে পূর্বের চেয়ে একটু দ্রুত ফিরে আসছে। আমরা সবাই উৎকণ্ঠিত জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কাছে আসতেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে, কী বলছে ওরা?’

—ওরা বলছে আমরা আপনাদের সব কথা শুনেছি। আমরাও বাঙালি। মিলিটারীতো, আমাদের একটা ‘ডিসিপ্লিন’ আছে। আমাদের অফিসাররা নির্দেশ দিলেই আপনাদের সাথে যোগাযোগ করব। আমরা আমাদের হেডকোয়ার্টার জয়দেবপুরে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।

আমি যখন মণীন্দ্রমোহন ঘোষের সাথে কথা বলছিলাম তখন একজন ছাত্র দৌড়ে এল। সে আমাদের মাঝে এসে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘চিটাগাং বেতার আমাদের দখলে। মেজর জিয়া নামে একজন বাঙালি মিলিটারি অফিসার চিটাগাং বেতারে বক্তৃতা করছে। এই যে আমি টেপ করে এনেছি’ এই বলে সে ক্যাসেট রেকর্ডার হাতে তুলে দিল। আজ আমি তার নাম স্মরণ করতে পারছি না। যদিও মনে রাখা উচিত ছিল, কিন্তু ক্যাসেটটা পেয়ে এতই খুশি হয়েছিলাম যে আমার কিছুই খেয়াল ছিল না।

ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে প্রথমে নিজেরা শুনলাম। হ্যাঁ, একজন বাঙালির কণ্ঠ। তিনি ইংরেজিতে নিজেকে মেজর জিয়া বলে দাবি করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে সকল বাঙালি সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু সুস্থ আছেন। তিনি নিরাপদে কন্ট্রোলরুম থেকে আমাদের সর্বরকম নির্দেশ দিচ্ছেন। বিশ্ববাসীর কাছে আমরা সাহায্য চাই। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু

মেজর জিয়ার বক্তৃতা শুনে তাড়াতাড়ি তা আবার মাইকে প্রচার শুরু করা হলো। মণিকে এরমধ্যে আরেকবার পাঠিয়েছি। তাকে বলে দিয়েছি, আমরা সেনাবাহিনীর কারো সঙ্গে সামনা সামনি কথা বলতে চাই। আপনারা কেউ আসুন। মেজর জিয়ার বক্তৃতা তখন মাইকে বেজে চলেছে। মণি এবার তার সাথে ইকবালকে নিয়ে গেছে। মণি সার্কিটহাউসে থাকবে, তার বদলে সেনাবাহিনীর একজন আমাদের কাছে আসবে। হলোও তাই। ওরা সার্কিটহাউসে গেটের সামনে পৌঁছলে তিন-চার জন এগিয়ে এসে কিছু কথাবার্তা বলল। মণি ওদের সাথে থেকে গেল আর ইকবাল মিলিটারিদের একজনকে নিয়ে আমাদের কাছে এল। ইকবালের সাথে আসা হাওলদার সাহেবকে খুব হাসিখুশি ও বিনম্র মনে হলো, তিনি যেন আমাদের কতকালের পরিচিত।

উনি এসেই বললেন, “দেখেন, আপনারাতো আমাদেরই ভাই। আমরাও আপনাদের ভাই। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি, কিন্তু মিলিটারি তো! আমাদের আলাদা ডিসিপ্লিন আছে। আমরা নিজে থেকে কিছু করতে পারি না। নিজেরা কিছু করলে কোর্ট মার্শাল হয়ে যাবে হেডকোয়ার্টার থেকে বললেই আমরা আপনাদের সাথে এক হয়ে যাব। সুবেদার সাহেব অনুরোধ করেছেন, আপনারা আমাদের মতামত জানাতে একদিন সময় দিন।” হাওলদারের কথা শুনে আমি বললাম, “দেখুন, সুবিধা-অসুবিধা আমরাও বুঝি।

কিন্তু এখন এমন একটা সময় এসেছে যখন অনেক কিছুই নিয়মের সাথে তাল রেখে নির্দেশমতো হবে না। আজ একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে কিছুকিছু এমন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে যা ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমি আপনার সুবেদার সাহেবের সাথে সরাসরি কথা বলতে চাই। আপনাদের কোম্পানি কমান্ডার কে? ক’জন অফিসার আছেন? তারা বাঙালি, না অবাঙালি?” আমার প্রশ্ন শুনে শুধু একমুহূর্ত চিন্তা করে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমাদের কোম্পানিতে পাঁচজন অফিসার। এদের তিনজন বাঙালি, দুইজন পাঞ্জাবি। আমাদের কোম্পানি কমান্ডার পাঞ্জাবি।

—ঠিক আছে, চলুন আমি আপনাদের সুবেদার সাহেবের সাথে কথা বলব। -তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি সুবেদার সাহেবের কাছ থেকে শুনে আসছি।

এই বলে তিনি ইকবালকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন এবং একটু পরে মণিকে নিয়ে আবার ফিরে এলেন। এসেই বললেন, ‘সুবেদার সাহেব উনার সাথে কথা বলেছেন। আপনার লোকের কাছেই শুনে দেখুন।

মণি বলল, “সুবেদার সাহেব বেলা বারটা পর্যন্ত সময় চাইছেন।”

অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর সবুর তার মুখ খুলল, “একজন আরেকজনের সাথে কথা কইব, তা আবার বারটা তেরটা ক্যান? দেহেনতো হাওলদার সাব। আপনাগোর কমান্ডার আমাগো কমান্ডারের সাথে কথা কইব, তা আর বারটা লাগব ক্যান? যক্ষন-তক্ষন কথা বলতে পারে। হাওলদার সাবগো আপনে যাইয়া বুঝাইয়া বলেন, নয় আমি যাইয়া বুঝাই।”

আমি হাওলদার সাহেবকে বললাম, “ঠিক আছে কোন সিদ্ধান্তে আসতে হবে না। সিদ্ধান্তে আসতে হলে হয়তো সময়ের দরকার হতে পারে। কিন্তু সাধারণ কথা বলতে তো কোন বাধা দেখছি না। সিদ্ধান্ত আপনারা বারটার পরেই নেবেন। আমরা এখন শুধু কথা বলতে চাই।”

‘এখনই সুবেদার সাহেবকে জানাচ্ছি’ বলে হাওলদার একাই চললেন। আমরাও পাঁচ সাতজন তার পিছুপিছু চললাম। হাওলদার শুধু যাচ্ছেন আর পিছু ফিরে বারবার বলছেন, “আপনারা এখানেই থাকেন। আমি আগে সুবেদার সাহেবের অনুমতি নেই। অনুরোধ করছি, আপনারা সাথেসাথে আসবেন না। আপনাদের ক্ষতি হতে পারে। আপনারা দয়া করে আমার কথা শোনেন।”

কিন্তু কে কার কথা শুনে! আমরা তাঁর পিছুপিছু সার্কিটহাউসে প্রধান গেটে পৌঁছে গেলাম। শেষমুহূর্তে ভদ্রলোক আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলে বললেন, “আপনারা নিজেরা তো মরবেনই, আমাকেও মারবেন। আমার স্ত্রী-পুত্র আছে। আপনারা একটু পিছিয়ে দাঁড়ান, আমি সুবেদার সাহেবকে আগে বলি।”

এতকিছুর পরেও কিন্তু আমরা হাওলদারের মুখে বিরক্তি কিংবা রাগের লেশমাত্র দেখলাম না বা রূঢ় কণ্ঠেরও কোন আভাস পেলাম না। শেষপর্যন্ত হাওলদারের অনুরোধে গেটের সামনে দাঁড়ালাম। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির সহকারী কমান্ডার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুবেদার জিয়াউল হক ভূইঞা তখন আমাদের থেকে মাত্র ২৫ গজ দূরে। ইকবাল আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ইকবালের মুখে শঙ্কার ছাপ। জেলগেটে দাঁড়ানো অপরাধীর মতো দেখাচ্ছে।

হাওলদার সাহেব সুবেদারের কাছে পৌঁছানো মাত্র জিয়াউল হক সাহেব আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। এসেই নম্রভাবে সালাম জানালেন। আমরাও তাকে সালাম জানালাম। সুবেদার বললেন, “ভাই, আপনারা ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। আমরা আপনাদের সাথেই আছি। আমরা আপনাদের ভাই। জয়দেবপুর থেকে খবর এলেই আমরা আপনাদের সাথে মিলিত হব।” এই সময় একজন নায়েব সুবেদার এসে বললেন, “১২টা নয়, ১০টার মধ্যে আমরা যদি জয়দেবপুরের সাথে যোগাযোগ করতে না পারি তাহলেও আপনাদের সাথে মিলিত হব।”

আমাদের পেছনে ইতিমধ্যে প্রায় হাজারখানেক লোক এসে দাঁড়িয়েছে। এবারে আর আড়ালে নয়, উন্মুক্ত প্রান্তরে। আমাদের এই তুলকালাম কাণ্ডের খবর হাইকমান্ড অফিসেও পৌঁছে গেছে। আমার ঠিক মনে নেই, সোহরাওয়ার্দী অথবা ছাত্রলীগের ফারুক ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বসল। পিছনে হাজার জনতার মুখেমুখে শ্লোগান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল। জনতার শ্লোগান শুনে সার্কিটহাউসের বাঙালি মিলিটারিরাও স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠ মেলালেন। শ্লোগানে শ্লোগানে নতুন জেলাশহর প্রকম্পিত ও মুখরিত হল।

সাধারণ সৈন্যরা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয়ায় আমরা খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠলাম। কে কার বাধা মানে। গেট ঠেলে সবাই ভিতরে ঢুকে পড়লাম। জনতার ভিড় বন্যার জলের মতো মুহূর্তে মুহূর্তে বেড়ে চলেছে। আমাদের সাথে তিন-চারশত মানুষ সার্কিটহাউসের ভিতরে ঢুকলেন। জনতা এবং আমরা এলোমেলো বিশৃঙ্খলভাবে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর বাঙালি ভাইদের সাথে বুকে বুক মিলাতে শুরু করলাম।

কোথায় গেল হেডকোয়ার্টারের অনুমতি, কোথায় গেল ১০টা-১২টার বেঁধে দেওয়া সময়। সকাল ৭টাতে সৈন্য-জনতার মহামিলন ঘটল। কোলাকুলি করে, নানা কথাবার্তা বলে সুবেদার সাহেবকে অনুরোধ করলাম, ‘সার্কিটহাউসের পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে ফেলুন। সুবেদার সাহেব তখন ১০টার ধান্ধায় আছেন। অনেক অনুরোধের পরও তিনি রাজি হলেন না। তখন আমরা সাধারণ সৈনিকদের কাছে গিয়ে পাকিস্তানী পতাকা সম্পর্কে কথা বললাম। সাধারণ সৈন্যরা অত্যন্ত আগ্রহভরে বললেন, আপনারা পতাকা নামিয়ে ফেলুন। আমরা কেউ বাধা দেব না।”

এরপর আর আমাদের পায় কে! টাঙ্গাইল সার্কিট হাউস থেকে এ.ডি.সি-র হেডলাইট ভাঙা (২৪ মার্চ বাংলা ছাত্রলীগের শামীম-আল-মামুনরা ইট-পাটকেল মেরে গাড়ির কাচ ও হেডলাইট ভেঙে দিয়েছিল) টাঙ্গাইল ক-৩ টয়োটা জিপ নিয়ে একই শহরের দিকে ছুটলাম। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের একটি ভালো পতাকা সংগ্রহ করা। গাড়ি নিয়ে সোজা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে গেলাম। সেখানে হাজার হাজার জনতার ভিড়। অফিসের সামনে হুমায়ুন দাঁড়িয়েছিল। হুমায়ুন তখন শহর ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক। পতাকা বানানোর দায়িত্ব তাঁরই। হুমায়ুনকে বললাম, তোর কাছে ভালো পতাকা আছে?’

—এখানে নেই, বাসায় আছে।

হুমায়ুনকে নিয়ে আবার ছুটলাম তাদের বাসায়। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী দৌড়ে এসে চিৎকার করে থামতে বললেন, কিন্তু আমি থামলাম না। হুমায়ুনের বাড়ি থেকে ভালো পতাকা ও কোরান শরিফ নিয়ে ঝড়ের বেগে সার্কিটহাউস অভিমুখে ছুটলাম। টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ রাস্তা ধরে আমাদের বাড়ির সামনে আসতেই দেখি, যমদূতের মতো রিভলবার হাতে বড়ভাই রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বারবার চিৎকার করে বললেন, ‘থাম, থাম’। এখানেও আমি গাড়ি থামালাম না। গাড়ির গতি সামান্য কমালাম মাত্র।

বড়ভাই পাগলের মতো চিৎকার করে বললেন, “তুই যদি সার্কিট হাউসের দিকে যাস, তাহলে আমি তোকে গুলি করব।” কিন্তু ততক্ষণে আমি তার রিভলবারের নাগালের বাইরে চলে গেছি। হতাশ হয়ে তিনি মোটরসাইকেলে আমার গাড়ির পিছুপিছু ছুটলেন। তার একমাত্র ভয়, আমি হঠকারিতা করছি। মিলিটারিরা আমাকে হত্যা করবে। তাই তিনি অত্যন্ত স্নেহান্ধ হয়ে গুলির ভয় দেখিয়ে আমাকে বিরত করতে চাইছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে তিনিও আমার পিছুপিছু সার্কিটহাউস পর্যন্ত এলেন।

আমি ঝড়ের বেগে সার্কিটহাউসে ঢুকলাম। চারপাশে জনতা তখন উপচে পড়ছে। গাড়ি থেকে নামতেই বড়ভাইও হাওয়ার বেগে এসে ভিড়ের মধ্যে মোটরসাইকেল থেকে লাফিয়ে পড়লেন। তিনি তখন গম্ভীর নির্বিকার। আমি বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে কোরান শরিফ অতীব শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে জড়িয়ে বড়ভাইয়ের হাতে দিলাম। তারপর আমরা সুবেদার জিয়াউল হকের সামনে এগিয়ে গেলাম। বড়ভাই দু’হাতে বাংলাদেশের পতাকা ও কোরান শরিফ ধরে আছেন। সুবেদার জিয়াউল হক আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে।

বড়ভাইকে অনুরোধ করলাম, “সুবেদারকে আপনার হাত থেকে পতাকা তুলে নিতে অনুরোধ করুন।” বড়ভাই বললেন, ‘তুই কর।” আদেশ পেয়ে আমি সুবেদারকে আহ্বান জানালাম, “বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ তাঁদের রক্ত পানি করে এতদিন আপনাদের বেতন জুগিয়েছে। আপনারা এতদিন পাকিস্তানের পতাকার সম্মান রক্ষা করেছেন। বাংলার সাড়ে সাতকোটি জনতার কামনা, আজ এইমুহূর্ত থেকে আপনারা তাদের সম্মান রক্ষা করুন। বাংলা ও বাঙালির সম্মানের প্রতীক—স্বাধীন বাংলার এই পতাকা আপনারা সমুন্নত রাখুন।

আমি জনতার পক্ষ থেকে অনুরোধ করছি, আমাদের সর্বাধিনায়ক গণপরিষদ সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর হাতের কোরান ও পতাকা স্পর্শ করে শপথ নিন, আপনারা জীবনপণ করে এই পতাকা সমুন্নত রাখবেন।” আমার কথা শুনে সুবেদার জিয়াউল হক মাথা নত করে অত্যন্ত শান্তভাবে কোরান ও পতাকার উপর ডান হাত রাখলেন। ফারুক ও সোহরাওয়ার্দীকে আমি বললাম, “সেই হাওলদার ও একজন সাধারণ সৈনিককে নিয়ে এসো।’ তারা দৌড়ে গিয়ে তাদের নিয়ে এল। চারজন হাত রেখেছেন পতাকা ও কোরান শরিফের ওপর। বড়ভাইকে বললাম, “শপথ করান। তিনি শপথবাক্য উচ্চারণ করলেনঃ

“আমি আজ বাঙালি জাতির নামে, দেশমাতৃকার নামে কোরান ও বাংলাদেশের পতাক স্পর্শ করে শপথ করছি, গত ২৫ বছর যে মর্যাদায় পাকিস্তানের পতাকাকে সমুন্নত রেখেছি, বাংলাদেশের পতাকাকে তার চাইতে অধিক মর্যাদা দেব। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে এর মর্যাদা রক্ষা করব। বাংলা ও বাঙালির সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষায় আমরা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করব। ন্যায়ের সংগ্রামে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ আমাদের ইয়াজিদদের মোকাবিলা করার তৌফিক দিন। আমিন।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী।”

শপথ শেষে সুবেদার জিয়াউল হক বড়ভাইয়ের হাত থেকে কোরানসহ পতাকা নিয়ে নিজের মাথায় এবং এক-এক করে অন্য তিনজনের মাথায় ঠেকালেন। তারপর পতাকায় জড়ানো কোরান বড়ভাইয়ের হাতে এবং পতাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “ভাই, এটা আপনারাই উঠান।” জনতা তখন আনন্দোন্মাদ হয়ে গেছে, চিৎকার করে না বললে কিছুই শোনা যায় না। সবুর ও মণীন্দ্রমোহন ঘোষ বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে একদৌড়ে সার্কিটহাউসের চূড়ায় উঠে গেল।

পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে তারা সোনালি সূর্যকরোজ্জ্বল রোদে সবুজ শ্যামল বাংলার বুকে নব প্রভাতের রঙিন আকাশে বাংলাদেশের বিজয়-পতাকা উড়িয়ে দিল। পাকিস্তানী পতাকা যেমন পপত্ করে উড়ে আমাদের বুকে প্রতিমুহূর্তে শেলের মতো আঘাত হানছিল, তেমনি বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখে আমাদের হৃদয়-মন অনাবিল আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠল।

এইসময় গণমুক্তি পরিষদের অন্যান্য নেতারাও সার্কিটহাউসে এসে উপস্থিত হন। পতাকা উত্তোলন শেষে পরিষদের চেয়ারম্যান গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ককে সবার উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে নির্দেশ দেন। বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী আধঘন্টা এক আবেগময়ী বক্তৃতা করেন। পতাকা উত্তোলন ও বক্তৃতা শেষে স্থির হলো, এখন থেকে সৈন্যদের খাওয়া-দাওয়া যাবতীয় প্রয়োজন পরিষদ মেটাবে।

শহরের সাথে তাঁদের টেলিফোন সংযোগ করে দেওয়া হলো। আমরা সার্কিটহাউস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু হাজার হাজার জনতা কিছুতেই যেন তাদের ভরসা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের ছাড়তে চান না। তারা কলসিভরা দুধ, কলা, খ, মাছ, মাংস, পেঁপে, পান, বিড়ি-সিগারেট—যে যা পারছেন তাই-ই সার্কিটহাউসে এনে স্তূপ করে ফেলছেন।

বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করায় হাইকমান্ড আমার উপর এত খুশি হন, যা আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। বড়ভাই এবং আসাদ ভাই সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছিলেন। টাংগাইলের সর্বস্তরের মানুষ এই সফলতার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দেন। দলমত নির্বিশেষে সবার প্রশংসা পেয়ে আমি খুবই উৎসাহিত বোধ করি এবং আরো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা পাই।

সারারাত ঘুমাইনি। তার উপর আবার মশার কামড় ও দারুণ উৎকণ্ঠায় আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই সার্কিটহাউস অভিযানে আমরা যারা জড়িত ছিলাম, তারা হাইকমান্ডের কাছে বিকেল পর্যন্ত ছুটি চেয়ে নিলাম। অভিযানের সাথে জড়িত ছিলাম—(১) সোহরাওয়ার্দী (২) আবদুস সবুর খান (৩) ফারুক আহমেদ (৪) মণীন্দ্রমোহন ঘোষ (৫) ইকবাল (৬) এন. এ. খান আজাদ (৭) আলী হোসেন (৮) মতি (৯) আবুল (১০) শোকন (১১) মিন্টু (১২) মণি সাহা ও অন্যান্যেরা।

কিছু খেয়ে আমাদের আকুর টাকুরের বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকেল তিনটায় বড়ভাই এসে আমাকে ডেকে তুললেন!

—তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। আমার সাথে যেতে হবে। জয়দেবপুর থেকে বাঙালি মিলিটারি এসেছে। তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য হবি মিঞা ও বদি ভাই চলে গেছে। তুই তাড়াতাড়ি চল।’ সার্কিট হাউসে সফল অভিযানে আমার প্রতি বড়ভাইর খুবই আস্থা জন্মেছে। শুধু বড়ভাই কেন, টাংগাইলের সবার মুখে তখন আমার সম্পর্কে একটা ধন্যধন্য রব।

ভাবতেই পারিনি, এত তাড়াতাড়ি বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আমাদের সাথে পাব। সকালে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলে, টাংগাইলের মানুষ যারপরনাই আশান্বিত হন। তদুপরি ঢাকার দিক থেকে আবার বাঙালি মিলিটারি এসেছেন এবং আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। এতে আমরা ভীষণ আশান্বিত হয়ে ভাবতে শুরু করে দিই, স্বাধীনতা আর বেশি দূরে নয়।

আমরা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানী হানাদারদের উপযুক্ত জবাব দিয়ে স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লালসূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হব। আনন্দিত চিত্তে নানা কথা ভাবতেভাবতে বড়ভাইয়ের সাথে গাড়ি ছুটিয়ে আরফান খানের পেট্রোলপাম্পের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, সুন্দর সুদর্শন বেঁটে-খাটো গোলগাল একজন মেজর একটা টুলের উপর বসে আছেন। তার পাশে আরও দুই-তিনজন ক্যাপ্টেন ও লেফটেন্যান্ট। সালাম জানাতেই হবি মিঞা আমাদেরকে মেজর শফিউল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

আমরা মেজর শফিউল্লাহর পরিচয় পেয়ে আরও আনন্দিত হলাম। অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে সাধারণ সৈন্যদের সার্কিটহাউসে ও অফিসারদের সংগ্রাম পরিষদ অফিসে নিয়ে আসা হলো। মেজর শফিউল্লাহ সংগ্রাম পরিষদ অফিসে রুদ্ধদ্বার কক্ষে চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খান, আহ্বায়ক লতিফ সিদ্দিকী ও উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামানের সাথে আলোচনা করলেন। আমরা সবাই খাবারের ব্যবস্থা করলাম।

জয়দেবপুর থেকে আসতে শফিউল্লাহর দলের দুতিনটি গাড়ি বিকল হয়ে গিয়েছিল। তাদের জন্য বিকল্প গাড়ির ব্যবস্থা করা হল। আলোচনা শেষে শফিউল্লাহ বেরিয়ে এলে আমরা হাইকমান্ডের চেয়ারম্যান, আহ্বায়ক ও উপদেষ্টাদের কাছে শুনতে পেলাম, জয়দেবপুরে তখনও এক কোম্পানি বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য যানবাহনের অভাবে পড়ে রয়েছে। আর শফিউল্লাহ নিজে দুই কোম্পানি নিয়ে এসেছেন। হাইকমান্ডের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা শেষে শফিউল্লাহ অফিসারদের নিয়ে সার্কিটহাউসে চলে গেলেন। তখন আমরা খুবই উৎসাহিত বোধ করছিলাম। কিন্তু আমাদের এই উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment